|| বাংলার নবাবের ওয়েবসাইটে স্বাগতম ||
আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া | ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া।

শুক্রবার, ২১ মে, ২০১০

বিশ্বসৃষ্টিতে কোরাণের পাঁচটি বিষয়

আজকের বেশিরভাগ তরুণ বিজ্ঞানীর চিন্তাধারা খ্যাতিমান অথচ চিন্তার দিক থেকে চরম মনোভাবাপন্ন বিজ্ঞানীর চিন্তাধারার আদলেই পরিগঠিত হয়ে চলেছে। নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত জনৈক চিকিৎসাবিজ্ঞানী বছর কয়েক আগে সর্বসাধারণের বুঝবার উপযোগী একখানা বই লিখে এখন পর্যন্ত এই মর্মে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন যে, বিভিন্ন মৌলিক উপাদান যেকোন সুযোগে হঠাৎ করে জীবন্ত কিছুর সৃষ্টি ঘটাতে পারে। তাঁর মতে, এভাবে পরিবেশগত বাহ্যিক প্রভাবে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীবন্ত প্রাণির উদ্ভব ঘটেছে। আর এভাবে জটিল প্রক্রিয়ার পরিণতিতে সৃষ্টি হয়েছে মানুষ।
অথচ অন্যদিকের বিচারে প্রাণ তথা জীবনের উদ্ভাবনার ক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞানের এই ‘হঠাৎ আশ্চর্য তত্ত্ব’ সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেও মানুষকে নিঃসন্দেহে সহায়তা করতে পারে।
মানুষে জন্ম ও জীবন ধারার ব্যাপারে যেসব প্রক্রিয়া বিদ্যমান, সেই সম্পর্কে যতই গবেষনা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে—তা ক্রমশই জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ধরা পড়ছে। আর কেউ যখন এ বিষয়ে খুটিনাটি অনেক বেশি জেনে নিত পারছেন, তার পক্ষে আরো বেশি অবাক হওয়া ছাড়া উপায় থাকছেনা। বস্তুত জীবনের যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া, সে সম্পর্কে যত বেশি জ্ঞান আহরণ করা যায়, প্রাণের উদ্ভাবনার ক্ষেত্রে উপরোক্ত ‘হঠাৎ আশ্চর্য তত্ত্বের’ সম্ভাবনা ততই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে পড়ে। এভাবে জীবন সংক্রান্ত জ্ঞান--গবেষনার পথে আরো বেশি অগ্রসর হলে, বিশেষত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণুর ক্ষেত্রে পৌছালে পর দেখা যায়, সকল যুক্তিই একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রতিই অঙ্গুলী নির্দেশ করে। কিন্তু সুকঠিন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও অনেকেই তাদের ধ্যান-ধারণা কে তুচ্ছ বা নগন্য ভাবতে পারছেননা। বরং বিনয়ের পরিবর্তে তাদের মধ্যে মাথাচাড়া দিচ্ছে ঔদ্ধত্য ও অহংবোধ। এই অবস্থায় মানুষ যেমন তার আকন্দ ও ভোগের পথে চলতে গিয়ে সকল রকম প্রতিবন্ধকতা অস্বীকার করতে চায়; ঠিক তেমনিভাবেই অনেকে আজ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব। এটাই বস্তুত আধুনিক বস্তুবাদী-সমাজের মানসিক প্রতিচ্ছবি এবং আজকের পশ্চাত্য জগতে (এবং শিক্ষিত সমাজে) বস্তুবাদী এই ভাবধারা বিস্তার লাভ করেছে অধিক মাত্রায়।

কোরাণে বিশ্বসৃষ্টি-সংক্রান্ত পাঁচটি প্রধান প্রধান বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য বিদ্যমান। এবারে বিজ্ঞানের আলোকে এক এক করে সেইসব তথ্যের বিচার-পর্যালোচনা করা হবে।
১. কোরাণের মতে, আকাশসমুহ ও পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে ছয়টি সময়কালে। শুধু তাই নয়, কোরাণের বর্ণনামতে, উপরোক্ত ছয়টি সমকালের মধ্যেই মহাকাশের বস্তুনিশ্চয়ও সৃষ্টি হয়েছিলো; এবং উক্ত সময়কালের মধ্যেই পৃথিবীর যাবতীয় উন্নয়ন কর্ম এমনভাবে সম্পাদিত হয়েছিলো—যদ্দরুন এই গ্রহটি (জীবনধারণের যাবতীয় উপকরণসহ) মনুষ্য বসবাসের উপযোগী হতে পেরেছে। কোরাণের বর্ণনা মতে, পৃথিবীর এইসব উন্নয়নমুলক কর্মকান্ড সম্পাদিত হয়েছিলো চারটি সময়কালের মধ্যে। কোরাণের এই চারটি সময়কালের বর্ণনা থেকে যে-কারো মনে আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমানিত মানুষের আবির্ভাবের চারটি ভূতাত্ত্বিক পর্যায়ের কথা উদয় হওয়ে স্বাভাবিক। আমরা সবাই জানি, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাবের কালে কিভাবে চারটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছিলো। বলা অনাবশ্যক যে, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব-সংক্রান্ত এই চারটি পর্যায় বা সময়কাল হচ্ছে বিজ্ঞানের একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা বা Hypothesis। তবে, বাস্তবে সেই চারটি পর্যায়ে যে কি ঘটেছিলো, সে বিষয়ে বিজ্ঞানের নিকট সঠিক কোন তথ্য নেই।
এই প্রসঙ্গে আরো বলে নেওয়া দরকার যে, কোরাণের ৪১ নং সুরার ৯ থেকে ১২ নং আয়াতের বর্ণনানুসারে মহাকাশের বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্র ও পৃথিবী পরিগঠিত হয়েছিলো দুইটি সময়কালে বা পর্যায়ে। এক্ষেত্রে আমরা সূর্য এবং তার উপসৃষ্টি, বিশেষতঃ পৃথিবীর সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করতে পারি। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের পরিবেশিত তথ্য হল, গ্রহ-নক্ষত্র ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্ম সম্পাদিত হয়েছিলো দু’টি পর্যায়ে। এক, আদি নিহারিকার ঘনিভুত হওয়ার ঘটনায়; এবং দুই, সেই নিহারিকার বিভক্ত বা টুকরা হওয়ার ঘটনায়। বিজ্ঞানের এই তথ্য সুতরাং কোরাণের বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। কোরাণে পরিস্কারভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো – মহাকাশের ধুম্রমন্ডলীর দ্রবণ এবং পরবর্তী পর্যায়ে তার বিভক্তির মধ্য দিয়ে। অতএব, এক্ষেত্রে আমরা কোরাণের বর্ণনা ও বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তথ্যের মধ্যে পুরোপুরি মিল অর্থাৎ সঙ্গতি দেখতে পাচ্ছি।
২. বিজ্ঞান জানাচ্ছে, নক্ষত্র ও তার গ্রহ সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার দুটি পর্যায়ে ছিলো পরস্পর সংলগ্ন। এদিকে এই দুই সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার ঘটনা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত থাকার বিষয়টাও কোরাণের আয়ারতের দ্বারা প্রমানিত ও সাব্যস্ত হচ্ছে এবং আমরা তা ইতিমধ্যে পর্যালোচনাও করেছি।
৩. কোরাণে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের সৃষ্টির আদি-পর্যায়ে ছিলো ‘ধুম্রকুন্ডলী’। অর্থাৎ সৃষ্ট বস্তুসমুহ এই পর্যায়ে ছিল প্রধানত গ্যাসীয় অবস্থায়। বিজ্ঞানও বলছে, সৃষ্টির আদি ছিলো নিহারিকা বা ‘নেবুলা’—যা মুলত গ্যাসীয় ধুম্রকুন্ডলীর অনুরুপ। সুতরাং এক্ষেত্রেও কোরাণের বক্তব্য বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত তথ্যের সাথে পুরোপুরিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই সাব্যস্ত হচ্ছে।
৪. কোরাণে ৭ সংখ্যার উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, আকাশের সংখ্যা একাধিক বা অনেক। এই সাত সংখ্যার অর্থ ও তাৎপর্য আমরা ইতিপুর্বে আলোচনা করেছি। আধুনিক বিজ্ঞানও জানাচ্ছে যে, মহাশুন্য-পদার্থবিজ্ঞানের পর্যক্ষকবৃন্দ গ্যালাকটিক সিস্টেম বা ছায়াপথ-পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লক্ষ কোটি গ্রহ-নক্ষত্র সম্বলিত আসমান তথা মহাশুন্যের অস্তিত্ব প্রমান করেছেন। তারা এও দেখেছে ছায়াপথের সংখ্যা বহু। সুতরাং এক্ষেত্রে কোরাণের বক্তব্য আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা সত্য বলে প্রমানিত হচ্ছে। পক্ষান্তরে, আমাদের পৃথিবীর মত একাধিক গ্রহের অস্তিত্বের কথা কোরাণের বিভিন্ন আয়াতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞান এই সম্পর্কে এখনো তেমন কোন প্রমান দিতে পারছেনা। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই যে, বহু ‘পৃথিবীর’ অস্তিত্ব খুবই সম্ভব।
৫. কোরাণে ‘আকাশসমুহ’ তথা ছায়াপথ ও ‘পৃথিবী’র মাঝখানে অর্থাৎ এতদুভয়ের মধ্যবর্তী পর্যায়ে সৃষ্ট-বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। মহাকাশের জ্যোতির্বিজ্ঞান-পদ্ধতির সুসংগঠিত ধারার বাইরে সেতু বা সংযোজনকারী হিসাবে অবস্থিত বস্তু বা পদার্থনিচয়কে আমরা অনায়াসেই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থিত সেই সৃষ্ট-বস্তু হিসেবে শনাক্ত করতে পারি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যদিও কোরাণে বর্ণিত বিশ্বসৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায়-সংক্রান্ত বক্তব্যের সবটা আধুনিক বিজ্ঞান নিজস্ব তথ্য ও পরিসংখ্যান দ্বারা প্রমানিত ও সাব্যস্ত করতে পারছেনা; কিন্তু বিশ্বসৃষ্টি-সংক্রান্ত বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তথ্যের কোন বিরোধী বানী কিংবা বক্তব্য আমরা এ যাবৎ কোরাণে পাচ্ছিনা। কোরাণের এসব বাণী ও বক্তব্য, সুতরাং, ওহী প্রাপ্ত বাণী হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার অধিকারী। কেননা আমরা দেখেছি, বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে বাইবেলের পুরাতন নিয়মে যেসন বক্তব্য বিদ্যমান, বিজ্ঞানের তথ্য-প্রমানের আলোকে তা এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। অবশ্য এতে বিস্মিত হওয়ার তেমন কিছু নাই। কেননা বাইবেলের যে সেকেরডোটাল পাঠ থেকে আমরা বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে যেসব বক্তব্য পাচ্ছি সেসব রচিত হয়েছিল ইহুদিদের ব্যবিলন থেকে উৎখাতের প্রাক্কালে—পুরোহিতদের দ্বারা। এই পুরোহিতরা সে সময়ে এমনভাবে বাইবেলের এসব বাণী রচনা করেছিলেন, যেসব বাণীতে তাদের নিজেদের মনমত ধর্মতাত্বিক অভিমতই শুধু প্রতিফলিত হতে পেরেছিলো। তাছাড়া বিশ্বসৃষ্টি সম্পর্কে বাইবেলের বক্তব্যের সাথে কোরাণের বক্তব্যের এই যে দুস্তর ব্যাবধান-- তা আরও একটি কারণে সবিশেষ গুরুত্বলাভের অধিকারী। তাহলো, ইসলামের শুরু থেকেই মোহাম্মদের (দঃ) বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপন করে আসা হচ্ছে যে, তিনি বাইবেলের বর্ণনা হুবহু নকল করে কোরান রচনা করেছিলেন। কিন্তু কোরাণের বাণী ও বাইবেলের বক্তব্যের মধ্যে উপরে বর্ণিত ব্যাবধানই প্রমান করছে যে, এই অভিযোগ একান্ত অমুলক। বিশেষত বিশ্বসৃষ্টির ব্যাপারে বাইবেল ও কোরাণের বানীর এই আলোচনার দ্বারা এটাই প্রমানিত হয় যে, মোহাম্মদের (দঃ) বিরুদ্ধে উত্থাপিত উপরোক্ত অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন। আর যদি এই অভিযোগ সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় – তাহলে সে অবস্থায় এখানে যে প্রশ্নটি না জেগে পারেনা, তা হলোঃ চৌদ্দশত বছর আগে আবির্ভুত হয়ে কি করে একজন মানুষের পক্ষে বাইবেলের বাণীর ভুল-ত্রুটি যথাযথভাবে সংশোধন করা সম্ভব? কিভাবে তার পক্ষে সম্পূর্ণ নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি মোতাবেক বাইবেল থেকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ত্রুটিপূর্ণ বাণীসমুহ বাদ দিয়ে এমন সব বাণী ও বক্তব্য রচনা করে কোরাণে সন্নিবেশিত করা সম্ভব—যা এতদিন—এতকাল পরে কেবলমাত্র আজকের বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষনার সত্য বলে প্রমানিত হতে পারছে? সুতরাং ‘কোরাণ মোহাম্মদের (দঃ) নিজস্ব রচনা’ কিংবা তিনি ‘বাইবেলের বাণী থেকে নকল করে কোরাণের বাণী তৈরি করেছিলেন’ বলে যে ধারণা পোষন করা হয় – সে ধারণা আদৌ সত্য ও সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা, বিশ্বসৃষ্টি-সম্পর্কিত কোরাণের বানী ও বর্ণনা – বাইবেলের বাণী ও বক্তব্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।