|| বাংলার নবাবের ওয়েবসাইটে স্বাগতম ||
আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া | ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া।

মঙ্গলবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১০

আধুনিক জোতির্বিজ্ঞান ও মহাগ্রন্থ আল-কোরাণ

আধুনিক জোতির্বিজ্ঞান ও মহাগ্রন্থ আল-কোরাণ

গ্রহের সংখাঃ
প্রাচীনকালে পৃথিবী ছাড়াও আরও পাঁচটি গ্রহের অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষ অবহিত ছিলো। যেমনঃ বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহ। আধুনিক কালে এসে আরও তিনটি গ্রহের অস্তিত্ব আবিস্কৃত হয়েছেঃ ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো।

ধরে নেওয়া হয় যে, কোরানে ‘কাওকাব’ শব্দের দ্বারা গ্রহাদির কথা বলা হয়েছে— তবে গ্রহাদির কোন সংখ্যার উল্লেখ করা হয় নাই। হযরত ইউসুফ (আঃ) স্বপ্নে এগারোটি গ্রহ দেখেছিলেন—তবে সেখানে যেভাবে এসব গ্রহের কথা উল্লেখিত হয়েছে, তা নিছক ধারণা বা কল্পনা বলে প্রতীয়মান হয়। কোরাণের একটি সুবিখ্যাত আয়াতে ‘কাওকাব’ শব্দের অর্থ ও সংগা সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

“আল্লাহ আসমান সমুহ ও জমিনের আলো। তাঁহার আলোর উপমা যেন একটা তাক বা কুলঙ্গী, -- যাহার মধ্যে রহিয়াছে একটা আলোকময় বস্তু। এই আলোকময় বস্তুটি রহিয়াছে একটা কাঁচের পাত্রে। আর সেই কাঁচ পাত্রটি যেন একটি গ্রহ, -- যাহা মতির মত ঝকমক করিতেছে”। -- সুরা- ২৪, আয়াত- ৩৫।

গত জুলাই ১৬, ১৯৮৭ ইত্তেফাকের তৃতীয় পৃষ্ঠায় ‘সূর্যের দশম গ্রহ’ শীর্শক এক খবরে জানা গেছে, “মার্কিন বিজ্ঞানীরা ‘সূর্যের দশম গ্রহের’ সন্ধান পাইয়াছেন। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করিতে ইহার কমপক্ষে ৭০০ শত বছর লাগে এবং পৃথিবীর আকৃতি হইতে ইহা পাঁচ গুন বড়”। নাসা-- বিজ্ঞানী জন এন্ডার্সনের সাক্ষাৎকার। সংবাদসূত্র-ইউসিস।
১৯৮৯ সালে সূর্যের আরেকটি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৮৭ সালে আবিষ্কৃত গ্রহটির নামকরণ করা হয়ছে ‘ভলকান’ এবং সর্বশেষ ১৯৮৯ সালে আবিষ্কৃত গ্রহটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘এক্স’। এই নিয়ে সৌরমন্ডলে গ্রহের সংখ্যা দাড়ালো মোট ১১ টি। এবং এভাবে কোরাণের ১১ টি গ্রহের সংবাদ সত্য বলে প্রমানিত হলো।

মহাশূন্যে চন্দ্র ও সূর্যের নিজস্ব গতিবেগঃ

যে আরবী শব্দটির দ্বারা সূর্য ও চন্দ্রের এই নিজস্ব-সঞ্চালিত গতিবেগের কথা বোঝানো হয়েছে—সেটি হচ্ছে একটি ক্রিয়াপদ--- ‘সাবাহা’। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে আবর্তন সমাপ্ত করার পাশাপাশি চন্দ্র নিজস্ব অক্ষরেখার উপরেও পূর্ণভাবে একবার আবর্তিত হয়ে থাকে। এই উভয় ধরণের আবর্তণের ক্ষেত্রে তার সময় লাগে সাড়ে ২৯ দিন। আর যেহেতু চন্দ্রের এই উভয় ধরণের আবর্তন যুগপৎভাবে সংগঠিত হয়ে থাকে, সেহেতু আমরা পৃথিবী থেকে চাঁদের শুধুমাত্র একটা দিকই দেখতে পাই।

আপন মেরুদন্ডের উপরে ঘুরপাক খেতে সূর্যের সময় লাগে মোটামুটিভাবে ২৫ দিন। অবশ্য সূর্যের অক্ষরেখা ও মেরুর এই আবর্তনের মধ্যে কিছুটা বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। তবে মোটের উপরে সূর্যও নিজস্ব গতি-আবর্তনের চক্রে বাঁধা।
এদিকে আধুনিক বিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠিত তথ্যের দ্বারাও মহাশুন্যে সূর্য ও চন্দ্রের এই গতি-আবর্তন হচ্ছে সমর্থিত। সত্যি, সপ্তম শতাব্দিতে আবির্ভুত হয়ে কোন মানুষ- সে মানুষ যত বড় বিদ্বানই হোন না কেন- সূর্য ও চন্দ্রের গতি-আবর্তনের এই সঠিক তথ্য যে তিনি শুধুমাত্র নিজ জ্ঞানবুদ্ধির সাহায্যে কল্পনা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন, সেকথা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনা।

দিনরাত্রির ধারাঃ
এমন এক সময় ছিলো যখন সবাই ধরেই নিয়েছিলেন যে, এই পৃথিবীটাই হচ্ছে বিশ্বের মুল কেন্দ্র এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই সূর্য হচ্ছে আবর্তিত। সুতরাং, সূর্যের সেই পৃথিবী-কেন্দ্রিক পরিক্রমনের ফলেই দিনরাত্রির পালাবদল ঘটছে। সেকালে এই ধারণাটা ছিলো একান্ত স্বাভাবিক। সুতরাং সেকালে বসে দিনরাত্রির সেই পালাবদলের কথা বলতে গিয়ে কারো পক্ষেই কি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্যের সেই ঘূর্ণন-আবর্তনের কথা এড়িয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব ছিলো ? অথচ কোরাণের কোন সময়ই বলা হচ্ছে না যে, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্যের আবর্তনের ফলেই দিনরাত্রির পালাবদল ঘটছে। নিচে আমরা এতদসংক্রান্ত কোরাণের বিভিন্ন আয়াত তুলে ধরছি—

“তোমরা কি লক্ষ্য কর না আল্লাহ কিভাবে রাত্রিকে দিনের মধ্যে মিলাইয়া দেন এবং দিনকে মিলাইয়া দেন রাত্রির মধ্যে?” – সুরা- ৩১, আয়াত- ২০।

“তিনি কুন্ডলীর মত জড়াইয়া দেন রাত্রিকে দিনের উপর এবং তিনি দিনকেও কুন্ডলীর মত জড়াইয়া দেন রাত্রির উপর”। -- সুরা- ৩৯, আয়াত- ০৫।

সেই ‘কাওয়াবা’ শব্দের সর্বোত্তম অনুবাদ হচ্ছে, ‘To coil or to window অর্থাৎ কুন্ডলী পাকানো, কুন্ডলী পাকিয়ে জড়ানো’।

দিনরাত্রির পরিক্রমনের বেলায় বাস্তবে মহাশুন্যে কি ঘটে থাকে? সেই ঘটনা যে আসলে কি, একান্ত হালে মার্কিন-নভোচারীবৃন্দ মহাশুন্যযান থেকে নিজেরা তা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তার চিত্রও তারা তুলে রেখেছেন। এসময় তারা ছিলেন পৃথিবী থেকে অনেক-অনেক দূরে— চাঁদের বক্ষে। যেখান থেকে তারা লক্ষ্য করেছেন, পৃথিবীর যে অর্ধেক অংশ সূর্যের দিকে ফিরানো, সূর্য কি রকম স্থায়ীভাবে পৃথিবীর সেই পৃষ্টভাগ আলোকজ্জল করে রাখছে, কিভাবে ভূমন্ডলের উপর আবর্তিত হচ্ছে। অন্যদিকে সূর্যরশ্মি তুলনামুলকভাবে একই অবস্থান থেকে তার উপরে আলো বিতরণ করছে। এর ফলে, ২৪ ঘন্টায় পৃথিবী যখন আপন মেরুদন্ডের উপর আবর্তিত হচ্ছে -- তখনও ভূমন্ডলের যে অর্ধেক স্থানজুড়ে বিরাজ করছে আলো অর্থাৎ দিন এবং বাকী যে অর্ধেক এলাকা অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকছে অর্থাৎ রাত্রি – দিনরাত্রির সেই উভয় এলাকা একই সময়ে সেই একই আবর্তনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘দিনরাত্রির এই যে অবিরত আবর্তন’, —সেই বিষয়টাই কোরাণে উপরোক্ত ‘কাওয়াবা’ শব্দের দ্বারা এরকম সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।

এভাবে শুধুমাত্র আধুনিক যুগে এসেই মানুষ কোরাণে বর্ণিত ‘দিনরাত্রির অবিরত আবর্তনের’ ধারণাটা সহজে বুঝে নিতে পারছে। কেননা, এখন আমরা সূর্যের স্থিরভাবে আলো বিতরণ ও পৃথিবীর অবিরত ঘুর্ণন সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানতে পারছি। গোলাকার ভূমন্ডলে কুন্ডলী পাকানো অবস্থায় দিনরাত্রির এই যে অবিরত আবর্তন এবং একটির অভ্যন্তরে আরেকটির অনুপ্রবেশ—সেই বিষয়টাই কোরাণে এমন ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে যেন পৃথিবী যে গোলাকার – সেই ধারণাটা কোরাণ অবতীর্ণ হওয়ার কালেও সত্যি হিসাবে স্বীকৃত ছিলো। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা মোটেও তা নয়। অর্থাৎ পৃথিবী যে গোলাকার সেরকম কোন ধারণা তখন চালু ছিলোনা।

মহাশুন্যের বিবর্তনের ধারাঃ

সুর্য এমনই একটি নক্ষত্র যার বয়স মোটামুটিভাবে সাড়ে চারশত কোটি বৎসরঃ এটাই মহাশুন্য–পদার্থবিজ্ঞান বিশষজ্ঞদের সর্বশেষ রায়। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে সূর্য তার বিবর্তনের কোন্‌ পর্যায়ে রয়েছে এবং সেই সাথে অপরাপর নক্ষত্রেরও বিবর্তণ ধারার পর্যায় সমুহ কি কি- আধুনিক বিজ্ঞান আজ সে সম্পর্কে অনেক কিছুই নির্দিষ্ট করে বলতে সক্ষম। সূর্যের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন এটম যেভাবে হিলিয়াম এটমে রুপান্তরিত হচ্ছে—তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট বিচার করেই আধুনিক বিজ্ঞান এই মর্মে রায় দিচ্ছে যে, সূর্য এখনো তার বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। স্মর্তব্য যে, আধুনিক বিজ্ঞানের হিসাব মোতাবেক সূর্যসহ অপারপর নক্ষত্রের বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ের মেয়াদ হলো দশশত কোটি বছর। সুতরাং, থিয়রী অনুযায়ী সূর্যের বিবর্তনের এই প্রাথমিক পর্যায় আগামী আরও সাড়ে পাঁচশত কোটি বৎসর ধরে অব্যাহত থাকবে। আমরা আগেই দেখেছি, অনেক নক্ষত্র ইতিমধ্যেই বিবর্তনের এই প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রম করে দ্বিতীয় পর্যায়ে পৌছে গেছে। কেননা, ঐসব নক্ষত্রের অভ্যন্তরস্থ হাইড্রোজেন রুপান্তরিত হয়ে হিলিয়ামে পরিণত হওয়ার ব্যাপারটা পূর্ণ পরিণতি লাভ করেছে। ফলে, রুপান্তরের প্রক্রিয়ার ঘটেছে পরিসমাপ্তি। পরণতিতে, ঐসব নক্ষত্রের উপরিস্তরের প্রবৃদ্ধিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিবর্তনের এই একই ধারায় সূর্যের উত্তাপ হ্রাস পাচ্ছে বলেও নীরিক্ষায় ধরা পড়েছে। সূরা (৮১) তকবিরের ১ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ “সেইদিন সূর্যের আলো নিস্প্রভ হইয়া পড়িবে”।

আধুনিক বিজ্ঞান তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরে এই মর্মে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছে যে, বর্তমানে সৌরমন্ডলীয়-পদ্ধতিতে যে অবস্থাটা বিরাজ করছে, আগামী কয়েকশত কোটি বছর পর সেই অবস্থা আর থাকবেনা। অন্যকথায়, চুড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত নক্ষত্রসমুহের প্রতিটি পর্যায়ের অবস্থা প্রমান-দলিল সহ বিচার বিশ্লেষন করে এই মর্মে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে যে, একইভাবে সূর্যের অন্তিম দশাও একদিন ঘনিয়ে আসবে।

কোরাণের ৩৬ নং সূরার ৩৮ নং আয়াতে চন্দ্র ও সূর্যের পথ পরিক্রমায় তাদের উভয়ের জন্য গন্তব্যস্থল হিসেবে নির্ধারিতি একটি স্থানের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়ঃ

“সূর্য তার নির্ধারিত স্থলের উদ্দেশ্যে পথ-পরিক্রমায় নিরত। ইহা মহাপরাক্রমশালী সুবিজ্ঞ সত্তারই নির্ধারিত ব্যাবস্থা।”
উপরে উদ্ধৃত কোরাণের আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, সূর্য তার একটা নিজস্ব নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের দিকে দ্রুত ধাবমান।"

বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, সূর্যের এই নিজস্ব গন্তব্যস্থলটি যে কোথায়, আধুনিক জোতির্বিজ্ঞান তা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেঃ এমনকি জোতির্বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে সূর্যের সেই নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের নামকরণ পর্যন্ত করে ফেলেছেন। নামটা হলোঃ সোলার এপেক্স। বস্তুত গোটা সৌরমন্ডল মহাশুন্যে অবস্থিত ‘Constellation of Hercules’ নামক একটি কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। আর সেই কেন্দ্রটির অবস্থান মহাশুন্যের ঠিক কোন্‌ স্থানে- আধুনিক জোতির্বিজ্ঞান তাও সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিজ্ঞান-বিশ্বে তা প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, সেই নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে সৌরমন্ডলের এগিয়ে চলার গতিও আধুনিক জোতির্বিজ্ঞান নির্ধারণ করে ফেলেছে; -- আর সেই গতিটা হচ্ছে মোটামুটিভাবে প্রতি সেকেন্ডে ১২ মাইল।

কোরাণের মাত্র দু’টি আয়াতের যে বক্তব্য, সে সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়েই আমাদের মহাশুন্য-সংক্রান্ত আধুনিক বিজ্ঞানের এত সব তথ্য-পরিসংখ্যান তুলে ধরতে হলো। দেখা যাচ্ছে যে, এক্ষেত্রে কোরাণের বক্তব্য এবং আধুনিক বিজ্ঞানের দলিল-প্রমান ও তথ্য-পরিসংখ্যানের রায় এক এবং অভিন্ন।

উপসংহারে, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এভাবে জোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত জ্ঞান-গবেষনার পথে আরো বেশি অগ্রসর হলে, বিশেষত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-পরমাণুর ক্ষেত্রে পৌছালে পর দেখা যায়, সকল যুক্তিই একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রতিই অঙ্গুলী নির্দেশ করে।


Dr. Maurice Bucaille ‘র The Bible, The Qur’an and Science’ অবলম্বনে
এতদসংক্রান্ত পূর্বের লেখাটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।