|| বাংলার নবাবের ওয়েবসাইটে স্বাগতম ||
আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া | ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া।

শুক্রবার, ২১ মে, ২০১০

প্রেমের রসায়ন

উপক্রমনিকাঃ
নানা মুনীর নানা মত। প্রবাদের এই কথাটি প্রেমের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। বহুজন বহুভাবে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন প্রেমকে। ডিম আগে না মুরগী আগে -- এই কিনারাহীন প্রশ্নের মতই বহুজন ধোয়াশায় আচ্ছন্ন হয়েছেন -প্রেম আগে না যৌনতা আগে- এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে। প্রেমের দিকে একপর্যায়ে দৃষ্টি পড়েছে যুক্তিবাদী বিজ্ঞানীদের।

প্রেম কি সহজাত প্রবৃত্তি না নিছকই মানব-সংস্কৃতি বা সভ্যতা প্রসূত একটা ধারণা মাত্র? গবেষনায় দেখা গেছে-- বিবর্তন, জীববিজ্ঞান ও রসায়নবিদ্যা এই তিনটা শক্ত ভিতের উপরেই প্রেম নামক তাবুটার বাস। আফ্রিকান সমভুমিতে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ লাখ বছর আগে প্রথম মস্তিস্ক থেকে এক বিশেষ ধরণের নিউরো-কেমিক্যাল ক্ষরণ হয়। নারী ও পুরুষ এরই প্রভাবে একে অন্যের চোখের দিকে তাকায়। ঘামতে থাকে হাতের তালু, আঙুল-- জন্ম হয় এক নতুন অনুভূতির। যার নাম প্রেম।

বর্তমানে নৃতাত্ত্বিকদের গবেষনায় প্রেমের আয়ু নির্ধারিত হয়েছে মাত্র চার বছর। প্রত্যেক মানুষের মস্তিষ্কে থাকে প্রেম-মানচিত্র। সেই মানচিত্রে আঁকা মুখটার সঙ্গেই হয় প্রেম। একই সময়ে দু'জনের সঙ্গে প্রেম হওয়ার বিষয়টা তর্ক-সাপেক্ষ। দেখা গেছে, মোট স্তন্যপায়ীর প্রায় পাঁচ শতাংশের কম অংশ বিশ্বস্ত জোড় বাধে। স্তন্যপায়ী প্রাণীশ্রেষ্ঠ মানুষের প্রেমের প্রকৃতি একগামী; তবে অতি গোপন ব্যাভিচার সহ।

যেহেতু পুরুষ প্রথম থেকেই নারী পরিবর্তনে অভ্যস্ত, তাই তাদের বিবর্তিত জিন এখনো বহুগামীতার বার্তা বহন করে। অন্যদিকে সেই প্রাগৈতিহাসিক নারী, যিনি তার দলের নজর এড়িয়ে ঘন সবুজ বনের আড়ালে প্রেমমত্ত থাকতেন অবৈধ প্রেমিককে নিয়ে, তার জিন এর প্রভাবেই আজকের নারীর মানসে বহুগামীতা-প্রবনতা।

প্রেম রসায়নঃ
চোখে চোখ পড়া, হাতে সামান্য হাতের স্পর্শ-- মস্তিষ্কে এক রাসায়নিক বন্যার সূচনা করে যা স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মানবদেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র প্রক্রিয়াটি হতে মাত্র পাঁচ অথবা সাত শতাংশ সেকেন্ড সময় লাগে। এমনি বিস্তারে রক্ত হয় বাহন। ফলে হাত ঘামা, ত্বকে রক্তিম আভা, দ্রুত নিঃশ্বাস ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। আসলে প্রেম আর উৎকন্ঠার বাহ্যিক প্রকাশ মোটামুটি একই রকম। প্রেমে পড়লে প্রচন্ড অকারণ আনন্দ বা ইউফোবিয়ার যে লক্ষণ দেখা যায়, তার জন্য দায়ী এমফেটামাইনের সমগোত্রীয় কিছু রসায়ন। যার মধ্যে নাম করা যায়-- জেপ্যামিন, নরএপিনেফ্রিন, ফিনাইল ইথাইল এমিন (PEA) ইত্যাদির।

যদি কেউ বলে, প্রেম তার কাছে নেশার মত লাগছে, কিংবা যদি কোন প্রেমিক ঘন জ্যোস্না ভরা রাতে তার প্রেমিকার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে-- তোমার চোখে নেশা ধরে যাচ্ছে, তাহলে সেটাকে নিছক ফিল্মি ডায়ালগ বলে উড়িয়ে দেয়ার কোন অবকাশ নেই। আসলে এটা ফিনাইল ইথাইল এমিন (PEA)-এর নেশা। তবে প্রসংগত উল্লেখ্য, এই PEA-এর নেশা অনন্তকাল থাকেনা। যার ফলে রোমান্টিক প্রেমও স্বল্পায়ু। যে কোন এমফেটামিনস্‌ এর মতই এই কেমিক্যালও শরীরে সঙ্গে টলারেন্স-ডিপেন্ডেন্স (Tolerance-dependence) এর খেলা খেলে। ক্রমশ শরীরে এই PEA টলারেনস্‌ তৈরি হয়। ফলে একই পরিমান প্রেমানুভূতির জন্য আরও বেশি পরিমান PEA দরকার পড়ে। দুই তিন বছরের মধ্যে PEA টলারেনস্‌ এতটা বেড়ে যায় যে, রোমান্টিক প্রেম জাগাতে যতটা পরিমান PEA দরকার শরীর তা' আর তৈরি করতে পারেনা। ফলে প্রেমের অনুভূতি আর তেমন তীক্ষ্ম থাকেনা। এই PEA টলারেনস্‌ তৈরি হওয়ায় প্রেমের তীব্রতা হারানো অনেকে সহ্য করতে পারেনা। ফলে স্বাদ পেতে অনেকেই ছুটে বেড়ান নির্দিষ্টতার সম্পর্ক থেকে আরেক সম্পর্কে, স্থান থেকে স্থানান্তরে। তবুও বহু প্রেমই টিকে থাকে উম্মত্ত স্তর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও। এরজন্য বাহ্‌বা দেয়া যায় আরেক শ্রেণীর রাসায়নিক সামগ্রিকে।

একজন সঙ্গীর ক্রমাগত উপস্থিতি অনেক সময় মস্তিষ্কে এনডরফিন্‌ জাতীয় রাসায়নিকের ক্ষরণ নিশ্চিত করে। এই জাতীয় রাসায়নিক আনন্দের তুবড়ি না ফোটালেও শান্ত সমহিত ভাব সৃষ্টি করে। বলা যায়, এগুলো প্রকৃতিজ যন্ত্রনা নিবারক। সঙ্গীর উপস্থিতির প্রভাবে ক্ষরিত এই এনডরফিন্‌ ক্রমাগত নিরাপত্তাবোধ ও শান্তি দেয়। দম্পতিদের মধ্যে একে অপরকে ছেড়ে গেলে অথবা একজন মারা গেলে এই এনডরফিনের ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে দূর্বিষহ হয়ে ওঠে জীবন।

প্রেমের ক্ষেত্রে আর একটা জৈব রাসায়নিক অক্সিটোসিনের ভুমিকা উল্লেখ না করলে এই রচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মস্তিষ্ক উৎষারিত এই যৌগ স্নায়ু ও পেশীর সংকোচন ও উদ্দীপিত করে। নারীর ক্ষেত্রে এই পদারতথ প্রসবের সময় জরায়ুর সংকোচন বা প্রসারনে সাহায্য করে এবং স্তনে দুগ্ধ উৎপাদন ঘটায়। একনকি বাচ্চাদের আদর করার নেপথ্যেও এই অক্সিটোসিন। সর্বশেষ গবেষনায় জানা গেছে, পরিণত নারী-পুরুষের আদর করার ইচ্ছাও নিয়ন্ত্রিত হয় এই অক্সিটোসিন দ্বারা। সাধারণতঃ একজন পুরুষের আদর করার ইচ্ছা তখনই হয়, যখন তার রক্তে অক্সিটোসিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে তিনগুন থেকে পাঁচগুন বেশি থাকে। নারীর ক্ষেত্রে অক্সিটোসিনের মাত্রা আরও বেশি হয়।

সর্বশেষঃ পরিসংখ্যানঃ
১. সারাজীবনে একজন মানুষ প্রেমে পড়ে ছয়বার।
২. প্রায় ২৫% লোকের জন্মই যেন প্রেমে পড়ার জন্য। সারাজীবনে এরা প্রায় বার দশেক প্রেমে পড়েন।
৩. মেয়েরা নাকি এক পলকে প্রেমে পড়ে। একইরকমভাবে তাদের প্রেমাবসানও ঘটে। এদের ৭০% এর ক্ষেত্রেই পরিণতি হচ্ছে বিচ্ছেদ।
৪. প্রায় বারো ভাগ মানুষের জীবনে দু' একটা প্রেম হয়ে যায় নাকি নিজের অজান্তে।