তার ওপর সবকিছুর খরচ যেভাবে বাড়ছে তাতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। সেদিন মহাজন বলছিল, সামনের মাস থেকে রিক্সার ভাড়া নাকি আশি টাকা করবে। বউ-মেয়ে নিয়ে না খেয়ে মরা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই রইস মিয়ার সামনে। এরকম সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই রিক্সা নিয়ে মহাজনের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে সে। মহাজনের কাছে রিক্সা জমা দিয়ে বাজার করতে হবে। বাড়িতে যে সবাই উপোস রয়েছে!
বাজারে ঢুকেই ভেবে কুল কিনারা থাকেনা রইস মিয়ার। এই সামান্য কটা টাকা দিয়ে কী কিনবে সে? কতদিন মাছ দিয়ে তরকারী খায়না তারা। অথচ মাছের কথা মুখেও আনতেও তার বাধছে। নিরামিষ খেয়েই চলে তার পরিবারের। নুন আনতে পান্তা ফুরায় যার অবস্থা, তার কি আর আমিষের কথা ভাবলে চলে? মাঝে মাঝে ভেবে কূল পায়না রইস মিয়া। আল্লা’ তা’লা কি তারে সারা জীবন এই অবস্থায় রাখবে? না নিজে ভাল কিছু খেতে পরতে পারে, না বউ-মেয়েদের কিছু খাওয়াতে পরাতে পারে! তার উপর গোঁদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দাড়িয়েছে তার এই বুড়ো বয়সটা। বুড়ো দেখে এখন অনেকেই তার রিক্সায় আর চড়তে চায় না। জগৎ সংসারে তার নিজেরে বড় অসহায় মনে হয়।
ঘরে ঢুকতে যেয়েই শুনতে পায় তার বড় মেয়ে আর বউ-এর গলা। ঝগড়া সারাদিন প্রায় লেগেই থাকে। বউ তার আঁইবুড়ো মেয়েকে আর ঘরে রাখতে চায় না। মেয়ের প্রতি মেজার তাই খিটখিটে থাকে। যেন, তাড়াতে পারলেই বাঁচে। বড় মেয়েকে নিয়ে রইস মিয়ারও চিন্তার শেষ নেই। বয়স তো আর কম হলোনা। এখন একটা বিয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু সে ক্ষমতা কি আর তার আছে? খরচ আর যৌতুকের টাকার কথা চিন্তা করলেই সব আশা শেষ হয়ে যায় রইস মিয়ার। মাঝে মাঝে ভাবে, আল্লা’ যদি তার উঠিয়ে নিতো তাহলেও সে তার অক্ষমতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেত।
ডাল দিতে ভাত খায় আর মনে মনে ভাবতে থাকে রইস মিয়া। কাল থেকে দ্বিগুন কাজ করতে হবে। আরেকজন মহাজনের কাছ থেকে আরেকটি রিক্সা নিয়ে বেশি সময় না চালালে কোনমতেই সে পেরে উঠবে না। বড় মেয়ের বিয়ের একটা ব্যাবস্থা এবার তার করতে হবে। ওদিকে মেজ মেয়েটাও ডাঙ্গর হয়ে উঠছে। সংসার খরচ আর নিজের উপার্জনের ক্ষমতা—এই দুইয়ের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে চোখে আন্ধার দেখে রইস মিয়া। গলা দিয়ে ভাত নামতে চায় না। এর মধ্যে বউ-এর বিলাপ, ‘ধাড়ী মেয়ে ঘরে রেখে কি পূজো দিতে হবে? বিয়ের একটা ব্যাবস্থা করতে পারছোনা?’ সারাদিনের সাত-পাঁচ ভাবনায় এমনিতের রইস মিয়ার মেজাজ খারাপ। তার উপর বউ-এর এমন তিরীক্ষি মেজাজ! হঠাৎ করে যেন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে সে। ভাত রেখে উঠেই দুম দুম দুটো কিল বসিয়ে দেয় বউ-এর পিঠে।
খুব ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে যায় রইস মিয়ার, খানিকটা আতংকে। দুশ্চিন্তায় আজকাল তার ঘুমও ঠিকমত হয়না। কাল রাতেই সে ভেবে রেখেছিলো, আজ থেকে বেশি করে রিক্সা চালাবে। এক মহাজনের রিক্সা জমা দিয়ে আরেকজনের। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে সে উঠে পড়ে। দু’টো ভাত মুখে দিয়েই বের হতে হবে। তাতের যদি সংসারের হালটা ধরা যায়! মনে মনে নিজের ভাগ্যকে গালি দিতে থাকে। ভাগ্যের উপর সকল দোষ চাপিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে পড়ে সে।
গতরাতের কথা ভাবতে ভাবতেই আনমনে খালি রিক্সা নিয়ে যাত্রীর পাওয়ার আশায় মোড়ের দিকে যাচ্ছিলো রইস মিয়া। এরই মধ্যে পিছন থেকে এসে রিক্সা সহ তাকে চাপা দেয় ঘাতক ট্রাক। দু’ একজন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলো। কেউ কেউ আবার ঘাতক ট্রাকটাকে আটকানো কথা বলছিলো। ততক্ষণে রাস্তার কালো পিচ রক্তে লাল হয়ে গেছে। কেউ একজন হাত ধরে পরীক্ষা করে বললো, ‘জানটা বের হয়ে গেছে’। সবাই আতংকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একটু দূরেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে তার রিক্সা। আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে থাকে জায়গাটা। ততক্ষণে খবর পৌছে যায় তার বাড়িতে। বিলাপ করতে করতে ছুটে আসে তার বউ আর তিন মেয়ে। তাদের যে আর কেউ রইলো না!