১.
মৌমিতার সবগুলো ভাবনাই মৌমিতাকে এলোমেলো করে দেয়। কতবেশি ভালো না বাসলে একজন মানুষ শুধুমাত্র তার ছেলের দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন পার করে দিতে পারেন! কতটুকু আদর্শিক না হলে একজন মানুষ সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে পারেন! কতবেশি স্বাপ্নিক না হলে একজন মানুষ তার ছেলেকে নীতি ও নৈতিকতার আদর্শে আদর্শিত করার স্বপ্ন দেখতে পারেন! কিন্তু সেই মহান, আদর্শবান, স্বাপ্নিক মানুষটিই আবার কি করে এতটা ন্যুয়ে পড়তে পারেন, কি করে শিশুর মত ঝরঝর করে কান্নায় ভেঙে পড়তে পারেন! বিশ্ব সংসারে প্রতিনিয়ত কত বিচিত্র কিন্তু হৃদয়-ছুয়ে-যাওয়া ঘটনাই না মানুষের জীবনে ঘটে চলেছে! কিন্তু হঠাৎ মুখোমুখি হওয়া এই পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়ে মৌমিতা। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় সে।
এমন শক্ত সামর্থ্য একজন মানুষকে অমন শিশুর মত কাঁদতে দেখে কাছে এগিয়ে যায়। বেঞ্চটার অর্ধেকজুড়ে বসে আছেন তিনি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মৌমিতা যে তাকে খেয়াল করছিলো তা লক্ষ্যই করেননি। হঠাৎ মৌমিতার উপস্থিতি টের পেয়ে একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। কি কথা বলবে বুঝতে না পেরে মৌমিতা বললো, ‘একটু বসতে পারি আপনার পাশে?’। কোন কথা না বলে তার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকে মানুষটা। হ্যাঁ বা না এর অপেক্ষা না করেই বসে পড়ে মৌমিতা।
২.
খুবই বিত্তশালী নন তিনি। তবে বিত্ত-বৈভবের প্রাচুর্য্য না থাকলেও ছেলেকে তা বুঝতে দেননি। ছেলের কোন আবদার অপূর্ণ রাখেননি। যখনই যা চেয়েছে তখনই তা এনে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। ছোট বেলায় মা হারানো ছেলেকে এত আদর আর ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন যে মায়ের অভাব ছেলেটা বুঝতেই পারেনি। জগৎ সংসারে ফয়সাল মাহমুদের ঐ একটাই সম্বল- আদরের একমাত্র ছেলে, রাইয়ান। নিজের হাতে ছেলেকে শিখিয়েছেন কি করে অ আ ক খ লিখতে হয়। নিজেই ছেলের সকল কাজকর্ম করেছেন। নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছেন, স্কুলে নিয়ে গিয়েছেন, আবার স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে এসেছেন, নিজের সাথে করেই বেড়াতে নিয়ে গিয়েছেন। শত কাজ বা ব্যাস্ততার মাঝেও ছেলের জন্য তিনি সময় বের করে নিয়েছেন। একজন আদর্শ বাবা হতে পেরেছেন কিনা তিনি নিজেও তা জানেন না, তবে আদর্শিক বিচারে অন্য অনেক বাবাদের চেয়ে তিনি অনেক এগিয়ে।
এত ভালোবাসার পাশাপাশি ছেলেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলারও সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন তিনি। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’ এই কথাতে বিশ্বাস করে হলেও সৎ থেকেছেন। মানুষ নাকি তার নিজের আদর্শ তার পরবর্তী বংশধরের মধ্যে দেখতে চায়। ছেলেও তার মত আদর্শিক হোক এটা তিনিও চেয়েছেন। এজন্য কখনই তিনি সৎ পথ হতে কোন অবস্থাতেই বিচ্যুৎ হননি। পাছে ছেলের উপর এর কোন প্রভাব পড়ে! নিজে কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি, অসৎ পথ অবলম্বন করেননি। ছেলেকে বুঝিয়েছেন ভালো-মন্দের পার্থক্য, ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ।
একটু একটু করে বড় হতে থাকে রাইয়ান। যে ছোট্ট রাইয়ান একসময় গল্প শুনতে শুনতে বাবার কোলের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তো, সে আর সেই ছোট্টটি নেই। স্কুল আর বাড়ির সামনের ছোট উঠান ছিলো রাইয়ানের গন্ডী। স্কুল শেষ করে বাড়ি, আর তারপর বিকাল হলে ছোট্ট ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে বাবার সাথে খেলা। রাইয়ানের জগৎ এখন সেই স্কুল আর বাড়ির সামনের ছোট উঠানটির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কিন্তু একমুহুর্তের জন্যও ছেলেকে চোখের আড়াল হতে দেননা ফয়সাল মাহমুদ। পরম মমতা আর ভালোবাসার সাথে নৈতিকতার মিশ্রণ ঘটিয়ে তিল তিল করে বড় করতে চান রাইয়ানকে। কিন্তু সময় থেমে থাকেনা। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বড় হতে থাকে রাইয়ানও। এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা এক উঠতি যুবক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেই পালটে যেতে থাকে রাইয়ান। নতুন কিছু ছেলের সাথে পরিচয় হয়। এতদিন ‘আবদ্ধ’ ছিলো বলে মনে হয় ওর। আস্তে আস্তে ওর চলাফেরায়ও পরিবর্তন আসতে থাকে। বন্ধুদের চাপাচাপিতে একসময় সিগারেট ধরে। দিনের রুটিনে আসে আমূল পরিবর্তন। বাবা হিসেবে ফয়সাল মাহমুদেরও চোখে এড়ায়না ছেলের এই পরিবর্তন। প্রথমত তিনি ব্যাপারটাতে অতটা আমল দেননি। ভেবেছেন, ছেলে বড় হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে—এখন একটু স্বাধীনতা সে ভোগ করতেই পারে। কিন্তু তিনি ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি কতটা অধপতন হতে পারে তার আদরের একমাত্র সন্তান রাইয়ানের। এই নষ্ট, ঘুনে ধরা নীতিহীন সমাজের নখর ছোবলে কতটা ক্ষত-বিক্ষত হতে পারে রাইয়ানের সমস্ত নীতি ও আদর্শ। মাঝে মাঝে অনেক রাত করে বাসায় ফেরে রাইয়ান। কখনোবা বন্ধুদের সাথে এসাইনমেন্ট করার কথা বলে রাতে আর বাসায়ই ফেরে না।
সকাল বেলা পত্রিকা হাতে নিয়ে ছেলের কথা ভাবতে থাকেন তিনি। গতকাল রাতেও বাসায় ফেরেনি রাইয়ান। ভাবতে ভাবতেই পত্রিকার পাতা উল্টাতে থাকেন ফয়সাল সাহেব। হঠাৎ পত্রিকার একটা ছবিতে চোখ আটকে যায় তার। এযে তার ছেলে রাইয়ান! ঈভ-টিজং করার সময় পুলিশের হাতে এরেষ্ট হয় রাইয়ান। সাথে তার আরো দুই বন্ধুও। ফয়সাল সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এই দেখার জন্যই কি তিনি এত মমতা আর আদর্শে মধ্যে বড় করেছেন ছেলেকে? বুকের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জিভুত হতে থাকে। একবার ভাবছেন, তিনি ছেলেকে আনতে যাবেন না। আবার ভাবছেন, মা হারানো এই ছেলেটির তিনি ছাড়া তো আর কেউ নেই।
সব দলা-পাকিয়ে-ওঠা ক্ষোভকে পাশে রেখে থানায় যান ফয়সাল সাহেব। ছেলেকে বাড়িতে আনার কোন ব্যাবস্থা করা যায় কিনা। কিন্তু থানার বড় কর্তা তার কোন কথাতেই কান দেননি, কোন ওজর-আপত্তি শুনতে চাননি। অবশেষে ব্যার্থ-মনোরথে বাড়ির পথে পা বাড়ান। কিন্তু বাড়ি আর ফেরা হয়নি ফয়সাল মাহমুদের। পথিমধ্যেই এই পার্কে এসে বসে পড়েন উদাস ভঙ্গিতে। মনের মধ্যে ভাবনাগুলো উঁকি দিতে থাকে তার আর ঝরঝর করে কাঁদতে থাকেন তিনি। কখন যে মৌমিতা এসে তার পাশে বসেছে তা টের পাননি।
৩.
বিকেলের নরম আলো মৌমিতার মুখে এসে পড়েছে। চারিপাশে এক কোলাহলরত আলোর উপস্থিতি। নাগরিক ব্যাস্ত জীবনের দ্রুততায় ছুটে চলেছে সহস্র মানুষ। কিন্তু বিষাদে ভরা মৌমিতার মন। ফয়সাল মাহমুদ তার জীবনে এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। নীতিভ্রষ্ট মেকী সমাজের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে এভাবে আর কত রাইয়ানকে অন্ধকারের কারাগারে বন্দি হতে হবে? আর কত ফয়সাল মাহমুদকে নিরবে নিভৃতে চোখের পানি ফেলতে হবে?