|| বাংলার নবাবের ওয়েবসাইটে স্বাগতম ||
আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া | ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া।

বুধবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১২

মাইনাস টু ফর্মুলার দুই প্রবক্তা

য়ান-ইলেভেন। পাঁচ বছর আগে ২০০৭ সালের এইদিনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রাষ্ট্রপতি প্রফসের ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।

রাজনীতির সঙ্গে কূটনীতির এক জটিল মারপ্যাঁচে সেদিন গোটা দেশতো বটেই বিশ্বেরও অনেকের নজর ছিলো বাংলাদেশের দিকে।

পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলো কয়েকটি মহল। যারা একটি পর্যায়ে ‘কুচক্রী হিসেবেই নাম কুড়িয়েছেন। দেশের ভালোর নামে ক্ষমতার কাছাকাছি চলে আসার এই প্রক্রিয়ায় তথাকথিত সুশীল সমাজের নামকরা প্রতিনিধিরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন রাজনীতির ভেতরের কিছু মানুষ, যারা সংস্কারের কথা বলে নেতৃত্বের ধারা পাল্টানোর বক্তৃতার খই ফোটাতে শুরু করলেন। আর পুরো ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক হয়ে মিডিয়ার ম্যাজিক বুলেট ক্ষমতাকে ব্যবহার করে একটি সফল ওয়ান ইলেভেনের জন্ম দিলেন হাতে গোনা গুটি কয় সাংবাদিক।

যার ফল হিসেবে পরের দিন অর্থাৎ ১২ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ফখরুদ্দীন আহমদ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আর দণ্ড-মুন্ডের কর্তা হয়ে ওঠেন তৎকালীন সেনা প্রধান মইন উ আহমেদ। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে শপথবাক্য পাঠ করান। 

পাচ বছর বাদেও ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে নানা কৌতূহল এখনও ফুরোয়নি। ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সেদিন কারা উল্লাস করেছিল। এ সরকার আনার পেছনে নিজেদের কৃতিত্ব নিয়ে যারা সগর্বে বলে বেড়িয়েছিল- সেকথা ঘুরে ফিরে সবার মনে আজও উঁকি দিচ্ছে।

বাদ নেই সেদিনকার মিডিয়ার ভূমিকাও। গণতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে সেনা সমর্থিত অগণতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসনকে স্বাগত জানিয়ে পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছিল নিবন্ধ। পুরো সময়টা তারা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে শুধুই গালমন্দ করে মনগড়া নিবন্ধ লিখে গেছে। এক্ষেত্রে শিল্পপতি লতিফুর রহমানের মালিকানাধীন দুটি পত্রিকা পালন করেছিল নাটের গুরুর ভূমিকা। একটি দৈনিক প্রথমআলো এবং অন্যটি ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার। নিরপেক্ষতার গালভরা বুলি আর যা কিছু ভালো তার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততার স্লোগানের আড়ালে গণতন্ত্রের ঘরে সেনাতন্ত্রের বিভীষণকে ফুলচন্দন দিয়ে বরণ করেছিল তারা।

আর সেসব নিবন্ধ লেখার তালিকায় অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন প্রথমআলো সম্পাদক মতিউর রহমান। বাদ যাননি ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামও। যদিও তারা সব সময় বড় গলায় বলে বেড়ান- তারা জনগণের কথা বলে থাকেন। দেশের কথা বলে থাকেন।

কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনে তাদের মুখোশ খুলে গেছে। কথায় আছে সুযোগের অভাবে সৎ থাকা। শুধু গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই নয়- এ দুই সাংবাদিক দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার চেষ্টায় আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন। তারা যে তত্ত্বের সেঁকোবিষ দেশের মানুষকে গেলাতে চেয়েছিলেন তার অপর নাম মাইনাস টু-থিওরি বা ফর্মুলা। এই তত্ত্বের সর্বনাশা ঝড়ে গোটা দেশের রাজনীতিতে নেমে এসেছিল ঘনঘোর এক অশুভ ছায়া। মাইনাস টু ফর্মুলার এই দুই প্রবক্তা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে সেনাতন্ত্রের পক্ষে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, তারা হয়ে উঠেছিলেন মোর ক্যাথলিক দ্যান দ্য পোপ।

নানাভাবে প্রবন্ধ-আর্টিকেল লিখে চরিত্র হননের চেষ্টা করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বর্তমান বিরোধীদলের নেতা ও তৎকালীন সদ্য-সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। মতি-মাহফুজ বা সংক্ষেপে এম-এম তাদের সম্পাদিত পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্য প্রতিবেদনে, নিবন্ধে, অলোচনায় বারবার এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা-হাসিনার থাকার কোনো যৌক্তিকতা আর নেই; গণতন্ত্র, দেশ, দেশবাসী তাদের হাতে নিরাপদ নয়। তাদের নানামুখি কূটচাল আর উস্কানিতে দুই নেত্রীকে স্থায়ীভাবে দেশছাড়া করার পথও প্রায় প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল্। কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের প্রাপ্য নাগরিক ও মানবিক অধিকারের পক্ষে মতি-মাহফুজকে কখনোই টু-শব্দটি করতে দেখা যায়নি।

মতি-মাহফুজ কলমের খোঁচায় শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে বিচারের দোষী সাব্যস্ত হবার আগেই দুর্নীতিবাজ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন দিনের পর দিন। এই দুই মহারথীর উস্কানির সুবাদে সেনা সমর্থিত নতজানু তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলায় জড়িয়ে দুই নেত্রীকে জেলখানায় পর্যন্ত পাঠায়। কতো কেচ্ছা-কাহিনী তখন ছাপা হয়েছে প্রথমআলো ও ডেইলি স্টারে তার ইয়ত্তা নেই। 

শুধু মামলা দিয়ে জেলেখানায় ঢোকানো নয়- দেশের দুই শীর্ষ দলের কিছু নেতাকে টোপ দিয়ে হাত করে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা হয়েছে। একনায়ক বলে গালাগাল করে মাইনাস করারও অপপ্রয়াস করা হয়েছে। তাদের এই অপপ্রয়াসকে আইয়ুব খানের তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের আরেক নিকৃষ্ট সংস্করণ বললে বরং কম বলা হয়।

ক্ষণিকের জন্য এসব করে তারা ভেবেছেন—বুঝিবা তাদের কেল্লা ফতে। কাজের কাজটি করে ফেলছেন ভেবে প্রথমআলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম মন্তব্য প্রতিবেদন আর নিবন্ধের পর নিবন্ধ লিখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। দেশবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতেই গণতন্ত্র নিরাপত্তা পেয়েছে।

শুধু কাগজে-কলমেই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গায়ে যাতে কাঁটার আঁচড় না লেগে সরকার পরিচালনা করতে পারে সেজন্য সরকারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ডেইলি স্টারের একজন পদস্থ নির্বাহী কর্মকর্তাকে।

তিনি হলেন- ডেইলি স্টারের সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ফাহিম মোনায়েম। তাকে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে পাঠানো হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমদের প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে।

দুটি বছর তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুণগান করে কাটিয়েছেন। আর প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার রাজনীতিবিদ ও দেশবাসীকে দেখাতে চেয়েছে তারা কতো শক্তিশালী।

তারাই চালাচ্ছে এ দেশ। তাদের কথায় সরকার ওঠা-বসা করছে। যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে দেশ পরিচালনা করছে। ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নেপথ্য থেকে তারাই বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে দেশ চালিয়েছেন।

নইলে দুর্নীতির দায়ে দেশের বাঘা বাঘা রাজনীতিক থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় বহু ব্যবসায়ীকে জড়ানো হয় দুর্নীতির মামলায়। আর সে সময় দিব্যি আরাম-আয়াসে দিন কাটিয়ে গছেনে ওই পত্রিকার মালিক লতিফুর রহমান।

অথচ তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও এতোটুকু আঁচড় লাগেনি সেদিন। চাঁদপুরে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার পর সেখানে শ্রমিকদের পাওনা মিটিয়ে না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়াও কিছুদিন আগেও ভারত ও বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় তার বিরুদ্ধে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি গোষ্ঠি উলফার( ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম) সঙ্গে সখ্য তথা আর্থিক লেনদেনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। 

অথচ মতি-মাহফুজের চোখে সব দোষ রাজনীতিকদের-- রাজনীতিবিদরা সবাই যেন চাঁদাবাজ-চোর। তারাই কেবল অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মনগড়া অভিযোগ এনে ওই দুই পত্রিকায় তালিকাও ছাপা হয়েছিল। আর জেলে ঢোকানো হয় দেড় শতাধিক নেতাকে। অথচ রাজনৈতিক নেতাদের স্ত্যী সন্তানদের পর্যন্ত ধরে নিয়ে জেলে ঢোকানো হয়। এমন ফ্যাসিবাদী অমানবিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে মতি-মাহফুজ বরাবরই মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছেন্।

আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এবং বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে সম্পৃক্ত করা হয় দল ভাঙার নেতৃত্বে থাকতে। ওই দুই পত্রিকায় এ দুই নেতাকে চিহ্নিত করা হয় ফেরেশতা হিসেবে। 

এতোসব সত্বেও বিশেষ সংস্থার দেওয়া র্দুনীতির তালিকায় বেরিয়ে পড়ে গেছে থলের বিড়াল। প্রকাশ পেয়েছে সাভারে স্বয়ং মতিউর রহমানের রয়েছে বাগানবাড়ি। যা নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও ছাপা হয়।

আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিএনপি এমপিদের সমর্থনেই রাষ্ট্রপতি প্রফসের ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ওয়ান ইলেভেন দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন।

অবশ্য রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যাওয়ার পর বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ওয়ান-ইলেভেন নিয়ে কিছু অপ্রিয় কথা তুলে ধরলেও তার স্ত্রী পরে বিবৃতি দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে মন্তব্য করেন। 

এদিকে ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির অভিযোগের অন্ত নেই। তাদের অভিযোগ, ওয়ান-ইলেভেন এসেছে দেশে নবম সংসদ নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন আগে। চাপের মুখে রাষ্ট্রপতি প্রফসের ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের পদত্যাগপত্র আদায় করে জারি করা হয় জুররি অবস্থা। এই জরুরি অবস্থার পক্ষে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি লেখেন এক উদ্দেশ্যমূলক নিবন্ধ। আর সে নিবন্ধে মতি লেখেন, ‘সাম্প্রতিক (তৎকালীন) প্রেক্ষাপটে দেশে জরুরি অবস্থা জারি ভিন্ন আর পথ খোলা নেই।’

বিএনপির বরাবরই বলে আসছিল, ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হচ্ছে সেনাসমর্থিত একটি পুতুল সরকার। আর ফখরুদ্দীন এক ইচ্ছাপূরণের কুশপুতুল। আর ইচ্ছা পূরণের সর্বনাশা খেলার অংশ হিসেবে ওয়ান-ইলেভেনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে দেশে শুরু করে বিরাজনীতিকরণ।

রাজনীতিকদের ঢালাওভাবে ‘দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিয়ে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সুযোগসন্ধানী কিছু রাজনীতিককে টোপ দিয়ে দল ভাঙার চেষ্টা চালানো হয়। এতে কাজ না হওয়ায় তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয় দল ভাঙার কাজে।

দল ভাঙার ষড়যন্ত্রে জড়ানো হয় নির্বাচন কমিশনকেও। সংস্কারের নামে দুই নেত্রীকে রাজনীতির বাইরে পাঠাতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকর করার চেষ্টা চলে।

ড. ফখরুদ্দীন আহমদ টানা দু’বছর ‘কঠোর’ হাতে দেশ শাসন করে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পর র্নিবাচিত গণতান্ত্রিক সরকার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

অপশাসন থেকে মুক্তিলাভ করে দেশের গণতন্ত্রমনা মানুষ।

বিএনপি এরপর থেকে ১১ জানুয়ারি দিনটিকে কালোদিবস হিসেবে পালন করে আসছে।