পাকিসস্তান ও ভারতের মধ্যকার বিরোধের সবচেয়ে বড় বিষয় কাশ্মির। অর্থনৈতিক, আর্দশিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক কারণের সাথে ভাবাবেগ ও অহংবোধ মিলে সমস্যাটিকে এত জটিল করে ফেলেছে যে, মনে হচ্ছে কোনোকালেই এর জট খুলবে না। আর এখানে সমঝোতা না হলে এই অঞ্চলের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং এর প্রভাব শুধু উপমহাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই পড়বে।
অথচ কাশ্মির সমস্যা দৃশ্যপটের সম্পূর্ণ আড়ালে চলে গেছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে হামলার পর থেকে সন্ত্রাসবাদই প্রাধান্য পাচ্ছে, কাশ্মির ইস্যু পাত্তা পাচ্ছে না। পাকিস্তান-ভারত আলোচনাতেও কাশ্মির প্রশ্নটি গৌণ হয়ে পড়েছে।
এমনকি ভারতও সামপ্রতিক অতীতে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, সেগুলোও পুরোপুরি আলোর মুখ দেখেনি। মুম্বাই হামলার প্রায় এক বছর পরে ২০০৯ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং কাশ্মির সফর করেছিলেন। ১৫তম লোকসভা নির্বাচনের পর এটাই ছিল তার প্রথম কাশ্মির সফর। ওই সময়ে তিনি বলেছিলেন, কাশ্মিরি গ্রুপগুলো সহিংসতা পরিত্যাগ করলে তার সরকার তাদের সাথে শর্তহীন আলোচনায় বসবে।
এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমও সমঝোতায় পৌঁছার লক্ষ্যে কাশ্মিরি গ্রুপগুলোর সাথে ‘নীরব’ আলোচনা শুরুর চেষ্টা করছেন। সম্পাদকদের সাথে এক বৈঠকেও তিনি বলেছিলেন যে, ‘আলোচনা হবে নীরবে, মিডিয়ার অগোচরে।’ তিনি বলেছিলেন, একটি রাজনৈতিক সমাধানসূত্র না পাওয়া পর্যন্ত এভাবে আলোচনা চালানো অত্যন্ত- জরুরি।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ওই ঘোষণা এমন এক সময়ে দিয়েছিলেন, যখন কাশ্মির উপত্যাকায় সহিংসতা ছিল এ যাবতকালের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস'ায়। তার এই উদ্যোগে অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তখন এমনও শোনা গিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের সাথে ব্যাপকসংখ্যক সৈন্য হ্রাস, বিতর্কিত সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন (এএফএসপিএ) প্রত্যাহারসহ কিছু আস'া সৃষ্টিকারী পদক্ষেপও (কনফিডেন্স-বিল্ডিং মেসারস- সিবিএম) গ্রহণ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের প্রতি কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাইদ স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, নিঃশর্ত আলোচনায় এই সমস্যা সুরাহায় সহায়ক হবে। কেন্দ্রের সাথে ‘আন-রিক ও ফলপ্রসূ আলোচনায়’ নিজের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে সর্বদলীয় হুরিয়াত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান মিরওয়াইজ ওমর ফারুক জোর দিয়ে বলেছিলেন, প্রস্তাবিত যেকোনো সমাধান রূপায়নের জন্য নয়াদিল্লি, ইসলামাবাদ, মোজাফফরাবাদ এবং একইসাথে কাশ্মিরের জনগণের অংশগ্রহণ থাকা জরুরি। তিনি আরো বলেছিলেন, বিতর্কিত আইন বিলোপ, সব বন্দীর মুক্তি ও সৈন্য প্রত্যাহারসহ হুরিয়াত কনফারেন্সের ছয় দফা দাবি পূরণ না করা পর্যন্ত সংলাপে তেমন সাফল্য আসতে পারে না। মিরওয়াইজ এটাও স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, কেন্দ্রের সাথে আলোচনায় যোগ দেয়া মানে এই নয় যে, তারা যেকোনো সমাধানের ভিত্তি হিসেবে কাশ্মিরি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংক্রান্ত হুরিয়াত কনফারেন্সের মূল দাবি থেকে সরে আসছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মির সমস্যার সমাধান হবে না। বরং পাকিস্তানকে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় আলোচনাতেই শান্তির পথ সৃষ্টি হতে পারে।
মনমোহন সিংয়ের আলোচনার প্রস্তাবে সবাই অবশ্য ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়নি। বিশেষ করে সৈয়দ আলী শাহ গিলানি ওই উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘১৯৫২ সালের ২৩ মার্চ থেকে কাশ্মির ও নয়াদিল্লির মধ্যে ১৩০ বারের বেশি আলোচনা হলেও এখন পর্যন- কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি। আলোচনার প্রস্তাব নতুন কিছু নয়।’
২০০৯ সালের নভেম্বরে চিদাম্বরম ও মিরওয়াইজ ওমর ফারুকের মধ্যকার দুই ঘণ্টার গোপন বৈঠকের খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। মিরওয়াইজ ওই বৈঠকের খবর অস্বীকার করলেও স্বীকার করেন, হুরিয়াত ও সরকারের মধ্যে ‘পেছন দরজার’ যোগাযোগ রয়েছে, তবে তা আলোচনা নয়। চিদাম্বরমের দফতর অবশ্য শুধু এটুকু বলেই সংযত ছিল যে ‘নীরব কূটনৈতিক’ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং তা প্রকাশ করা হবে না। এমন এক পরিসি'তিতে ২০০৯ সালের ১৮ নভেম্বর মিরওয়াইজ ওমর ফারুক মিডিয়ার সাথে আলোচনাকালে জানান, ‘অনেক কিছুই ঘটেছে। সম্ভাব্য সমাধানের প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ চলছে। একটি সমাধানের ব্যাপারে পাকিস-ানের পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে।’ তখন এমন খবরও প্রকাশিত হয় যে, পাকিস-ান ও ভারতের মধ্যকার সার্বিক আলোচনা বন্ধ থাকলেও ব্যাংককে দুই প্রতিবেশী বৈঠক করেছে এবং সাবেক পাকিস-ানি হাইকমিশনার আজিজ আহমদ খান ও সাবেক র-এর প্রধান এ এস দৌলত মীমাংসায় পৌঁছার চেষ্টা করছেন।
মিরওয়াইজ আরো বলেন, আলোচনার মূল বিষয় হলো সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের প্রস্তাবিত চার দফা। মোশাররফের চার দফার মধ্যে ছিল কাশ্মিরের পররাষ্ট্র, মুদ্রা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর যৌথ ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ। ভারত অবশ্য এই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। মিরওয়াইজ বলেন, কেন্দ্রের সাথে প্রকাশ্যে আলোচনা শুরুর আগে পেছন দরজার যোগাযোগই উত্তম। তিনি এটাও স্বীকার করেন, যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণেই শানি- আলোচনা বেগবান হয়েছে। সম্ভাবনার এই ক্ষীণ রেখাটি যখন দেখা যাচ্ছিল, তখন হুরিয়াত কনফারেন্সের অন্যতম নেতা ফজলুল হক কোরেশিকে হত্যার একটি চেষ্টা চালানো হয়।
এ দিকে ফলপ্রসূ আলোচনা শুরুর আগে দিল্লি আস'া অর্জনের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানায়। ২০০৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি ঘোষণা করেন, জম্মু ও কাশ্মির থেকে সেনাবাহিনীর দু’টি ডিভিশন (প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য) প্রত্যাহার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিসি'তির উন্নতি সাপেক্ষে তিনি আরো সৈন্য প্রত্যাহারের আশ্বাস দেন। তিনি কোনো কোনো এলাকায় এএফএসপিএ আবার বলবতের আশঙ্কা নাকচ করে দেন।
২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে সন্ত্রাসসংশ্লিষ্ট তৎপরতা ২৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ভারত অবশ্য পাকিস্তান থেকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রবেশের অভিযোগ উত্থাপন অব্যাহত রাখে। এতে আরো বলা হয়, ২০০৯ সালে অনুপ্রবেশের ৪৭৩টি চেষ্টা চালানো হয় এবং এগুলোর মধ্যে ৩৬৭টি চেষ্টা নস্যাৎ করা হয়েছে। এতে ৯৩ জন সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে এবং ২২৭ জন পাকিস্তানে পালিয়ে গেছে।
ভারতের আচরণে বেশ কিছু সাংঘর্ষিক বক্তব্য পাওয়া গেছে। এক দিকে তারা বলতে থাকে, কাশ্মিরের পরিসি'তি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শান-। আবার বলা হয়, পাকিস্তান থেকে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে, পাকিস্তান শান্তির জন্য কিছুই করছে না। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে এক কিশোর নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে কাশ্মির আবার উত্তাল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে নয়াদিল্লির কাছ থেকে আস্থা সৃষ্টিমূলক কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করা হয়।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কাসুরি প্রকাশ করেন, আগের সরকার ২০০৭ নাগাদ কাশ্মির সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক কাজ প্রায় ৯০ ভাগ শেষ করে এনেছিল এবং সমঝোতার ব্যাপারে শুধু পাকিস-ান, ভারত ও কাশ্মির প্রতিনিধিদের মধ্যে স্বাক্ষর বাকি ছিল।
তিনি আরো দাবি করেন, ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির আলোচকেরা তিন বছরের নীরব পরিশ্রমে যে দলিল চূড়ান- করে এনেছিলেন তা কয়েকটি বন্ধুপ্রতীম দেশে রক্ষিত রয়েছে। তিনি দাবি করেন, সমঝোতা হিসেবে ভারত অধিকৃত কাশ্মির ও আজাদ কাশ্মির উভয় স্থানেই পুরোপুরি অসামরিকীকরণ করার কথা ছিল। তারা একটি শিথিল স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারেও একমত হন। এতে ‘আজাদি’ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে ছাড় দেয়া হয়। কাসুরি বলেন, ‘আমরা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের মাঝামাঝি একটি সমঝোতায় উপনীত হয়েছিলাম।’ কিন্তু পাকিস্তানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে ওই সমঝোতার সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যায়।
২০১০ সালের ২৫ মে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আবারো ঘোষণা করেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সহিংসতা পরিত্যাগ করলে তার সরকার আলোচনায় বসতে রাজি। কিন' এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘কাশ্মিরে গণহত্যা ও সংলাপ একসাথে হতে পারে না।’ ২০০৮ সালে কাশ্মিরে নির্বাচনে ৬০ ভাগ ভোট পড়ায় সরকার বলার চেষ্টা করে যে তাদের চেষ্টা সফল হয়েছে। কিন্তু কাশ্মিরিরা আবারো প্রতারিত হয়। আর এর জবাবে তারা অস্ত্র হাতে নয়, রাজপথে নেমে আসে প্রতিবাদ জানাতে। এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো সৈন্য মোতায়েনে বোঝা যায়, পরিস্থিতি কত জটিল। ২০১০ সালের ৩০ মে ভারতীয় বাহিনী তিন কাশ্মিরিকে হত্যা করে মিথ্যা এনকাউন্টারের কথা বললে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
ভারত সরকার নিজের ব্যর্থতা স্বীকারের বদলে বরাবরের মতোই পাকিস্তানের ওপর সব দায় চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
ভারতেরও অনেকে বোঝে, কাশ্মিরে যেসব আন্দোলন হচ্ছে, তার সবই পাকিস্তানের ইন্ধনে হয় না। ভারত সরকারের দমনপীড়ন, ভুলনীতি, দুর্নীতি, অযোগ্যতার কারণে কাশ্মিরিরা অসন'ষ্ট। কিন' তাতে ভারতের ক্ষমতাসীনদের কিছু যেন যায়-আসে না। কাশ্মিরিদের কান্না থামাতে কিছু করার গরজ তারা অনুভব করে না।
ভারত সরকারের বোঝা উচিত, দমনপীড়ন চালিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে দমানো যায় না। কাশ্মির ইস্যুর মীমাংসা ছাড়া পাকিস্তান-ভারত সমস্যার সমাধান হবে না। ওই কান্না থামাতেই হবে।