কিশোর বয়সে যখন মুক্তিুদ্ধের ইতিহাস পড়তাম, শরীরে একটা শিহরণ জাগতো। আশঙ্কা, বেদনা আর মনের ভিতর এক টুকরো স্ফুরিত আলো -একটা স্বাধীন দেশ হবে আমাদের- অজানা গন্তব্যের এমন উদ্বেগময় দীর্ঘ নয় মাসের গল্প যখন পড়তাম, রক্তের উম্মাদনা তখন নিয়ে যেতো উম্মত্ত একাত্তরে।
ইতিহাস পড়ে শিহরিত হওয়া যতটা সহজ, ইতিহাসের সেই স্থানে অবস্থান করা ততটাই কঠিন। ইতিহাসের সঠিক পার্শ্বে সবাই অবস্থান নিতে পারেনা, পা পিছলে যায় অনেকের। তবু মনের ভেতর খেয়াল জেগে উঠতো, “ইশ! যদি একাত্তরে থাকতে পারতাম!”
আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাসে, আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন -আমাদের স্বাধীনতা। আন্দোলন আমাদের রক্তে মিশে আছে। আন্দোলনই আমাদের নিয়তি। আর, সেই নিয়তির সবচেয়ে সুন্দরতম মুহূর্তে উপস্থিত থাকার মতো কাঙ্খিত আর কোন বস্তু হতে পারে না। ৪৭ পেরিয়ে ৭১, এদেশের মুক্তিকামী জনতা আন্দোলনকে বেছে নিয়েছে তাদের মুক্তির একমাত্র সোপান হিসেবে।
তারপর ৯১ মাড়িয়ে আসলো ২৪।
জাতির ঘাড়ে সওয়ার হল সেই পুরনো শকুন! ১৫ বছরে ধীরে ধীরে পরিণত হলো এক মহিরুহু দানবে। এক সাইকোপ্যাথ পিশাচিনী আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা মিলে খুবলে খাওয়া শুরু করল এই জাতিকে। তখনই আবির্ভাব হল একদল তরুণের। হার-না-মানা দৃঢ়তা আর বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়ার সংকল্পচিত্ত নিয়ে এগিয়ে এল তারা। অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলনে তারা গেয়ে উঠলো-
বুকের ভেতর দারুন ঝড়
বুক পেতেছি গুলি কর।
৭১ ফিরে এলো ২৪-এ। একদিকে পিশাচিনীর বিষাক্ত শ্বাস, অন্যদিকে ছাত্র-জনতার প্রলয়োল্লাস।
একি রণ-বাজা বাজে ঘন ঘন-
ঝন রনরন রন ঝনঝন!
সেকি দমকি দমকি ধমকি ধমকি
দামা দ্রিমি দ্রিমি গমকি গমকি
যে তরুণেরা তাদের জাতীয় কবির এমন রক্তে আগুন ধরা গান শুনে বড় হয়েছে, তাদের রোদে সাধ্য কার! এই জুলাইয়েই হবে স্বৈরাচারীর পতন। তারা গুনতে শুরু করলো: ৩১শে জুলাই, ৩২শে জুলাই... ... ..।
পুরো বাংলাদেশ তখন রাস্তায় নেমে এসেছে। ঢাকার রাজপথে লক্ষ লক্ষ লোকের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে স্বৈরাচারের বিদায়। দখিনা বায়ুতে তখন বিজয়ের ঘ্রাণ। দিনটা ছিল ৩৬শে জুলাই।
এ বিজয় বাংলাদেশের, বাংলাদেশের আপামর জনতার। এ বিজয়ে শুধু বর্তমান প্রজন্মের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা হাসেনি, হেসেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কেরা; যারা একটি সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলো।