ঘটনা অনেকটাই চোখ-সওয়া হয়ে যাওয়ার মত। ধীরে ধীরে আপনার মনে জেঁকে বসবে, আপনাকে গ্রাস করবে। অথচ আপনি কিছুই টের পাবেন না। একসময় হয়তো আপনার অস্তিত্বই বিলীন করে দিতে চাইবে কিন্তু আপনি তখন যেন-কিছুই-হয়নি মনোভাব নিয়ে পড়ে থাকবেন আর খুইয়ে ফেলবেন আপনার স্বার্বভৌমত্ব। এবস্ট্রাক্ট এবং কংক্রিট উভয় ক্ষেত্রে এর প্রভাব সমভাবে বিদ্যমান। লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে এই উভয় দিক থেকে আপনার উপর যুগল আক্রমন চালানো হবে আর আপনি আপনার মডারেট চিন্তা-চেতনার গন্ডীর ভিতরে থেকে দিনের পর দিন এমন ভাবখানা দেখাতে থাকবেন যেন এমনটি তো হওয়ারই ছিলো। অনেকটা বেহুশ হয়ে থাকা অবস্থায় আপনার শরীরে ইঞ্জেকশান পুশ-ইন করার মত। আপনার শরীরে একটা ড্রাগ ঢুকিয়ে দেওয়া হলো অথচ আপনি কিছুই টের পেলেননা। আবার যখন হুশ ফিরে এলো তখনও আপনি কিছু টের পেলেননা কারণ ড্রাগটি তখন আপনার অজান্তে নিভৃতে আপনার শরীরে কাজ করে চলেছে। একটা সময়ে আপনি ঠিকই বুঝতে পারবেন আপনার শরীর আর আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু ভাগ্য তখন বড় অসহায়, আপনি আপনাকে হারিয়ে ফেলেছেন!
আমার উপরোক্ত কথাগুলো আপনার কাছে মুল্যহীন বিমুর্ত মনে হতে পারে। আমি কতগুলো ইলাস্ট্রেশানস্ -এর সাহায্য নেব। একটা পর্যায়ে আমার কথাগুলো আপনার কাছে মুর্তমান হয়ে উঠতে পারে। না হলেও দোষের কিছু নেই। চলুন দেখা যাক।
খুব ছোটবেলা থেকে আপনি যে মাঠটিতে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে আসছিলেন সেই মাঠটার কথায় ধরুননা! আপনি যখন মাঠে আসা শুরু করলেন তখন এই মাঠটি ছিলো অনেক বড়। গ্রামের বা মহল্লার বয়সে বড় যারা ছিলো তারা প্রায় পুরো মাঠ জুড়ে খেলাধুলা করলেও আপনার মত যারা ছোট ছিলেন তাদের জন্য জায়গা ছিলো মাঠের এক কোনে। আপনি কিন্তু সবসময় এই ছোটটি থাকেননি। আর তাই একসময়ে ভিড়ে গেলেন বড়দের দলে। এখন আপনি পুরো মাঠজুড়ে ক্রিকেট খেলেন। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছেন কি, এখন যারা বয়সে ছোট বা আপনাদের সাথে খেলাধুলা করার মত হয়ে ওঠেনি তারা কোথায়? তাদের কিন্তু আপনার মত মাঠের এক কোনে জায়গা হয়নি। কেন? খুবই সোজা উত্তর- মাঠটি আর আগের মত বড় নেই। আমি এই পরিবর্তনটার কথায়ই আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম। হয়তো কোন একদিন দেখলেন মাঠের এক পাশে ক্লাব করার নামে ছোট্ট একটি স্থাপনা গড়ে উঠেছে। কেউ আমল দেয়নি ব্যাপারটাতে। কারণ, তাতে আর কতটুকু জায়গা লাগতো? দেখতে দেখতে ওটা আপনাদের সকলের চোখ-সওয়া হয়ে গিয়েছিলো। তারপর, সমিতির জন্য আরেকটি স্থাপনা, কিছুদিন পর ক্লাব বা সমিতির স্থাপনাকে অনেক বড় করে তুলে দেওয়া। এইভাবে একের পর এক স্থাপনা গড়ে উঠেছে আর ছোট হয়ে এসেছে মাঠটি। কিন্তু কোন কিছুই আপনার চোখে লাগেনি। কারন, এই সবকিছুই একদিনে হয়নি। হয়েছে ধীরে ধীরে, এক এক করে, আপনার চোখ-সওয়া হয়ে।
উপরোক্ত ঘটনাকে আমি কংক্রিট বলছি। কারণ, এর প্রভাব একটা সময়ে হলেও প্রত্যক্ষ। ধীরে ধীরে আপনার মাঠ দখল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি আপনার মনের মধ্যেও প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। যেটাকে আমি এবস্ট্রাক্ট বলতে চেয়েছি। সেই ব্যাপারটিতে যাওয়ার আগে আসুন ছোট্ট আরেকটি এমন চোখ-সওয়া ঘটনার কথা জেনে নিই। আজ থেকে দশ বারো বৎসর আগের কথা একটু মনে করার চেষ্টা করুন । আমাদের দেশে টেলিভিশান বলতে আমরা ঐ বিটিভিকেই বুঝতাম। তখন এত চ্যানেলের আধিক্য ছিলোনা। প্রতি বৃহস্পতিবারে আপনি হয়তো একটা প্যাকেজ নাটক দেখার আশায় টিভি সেটের সামনে বসে থাকতেন। না, আমি নাটকের বিষয়বস্তু বা বিটিভির স্বায়ত্বশাসন নিয়ে কিছু বলবোনা। ওটা রাজনীতির বিষয়। আমি বলবো সে সময়কার নাটকের নায়িকাদের ড্রেস-আপ নিয়ে। আপনার যদি স্মরণ-শক্তি খুব দূর্বল না হয়ে থাকে, তাহলে মনে করতে পারবেন সেই সময়ে নায়িকাদের পোষাক কতটুকু লম্বা ছিলো –জানু থেকে অনেক নীচে, পায়ের গোড়ালীর সামান্য উপর পর্যন্ত। আর এখন, সেই টেলিভিশানের নায়িকারা ফতুয়া পরে আপনার চোখের সামনে শাবলীল ভঙ্গিতে অভিনয় করছে, ঘুরছে, ফিরছে বা গান গাইছে। আপনার কিন্তু চোখে লাগছেনা। কারণ, এই পরিবর্তন একদিনে হয়নি। নায়িকাদের পোষাক আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠেছে। আপনার থ্রেশোল্ড ভ্যালুকে (Threshold value) বৃদ্ধি করা হয়েছে। আপনার চোখ-সওয়া করে নেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে পোষাকের দৈর্ঘ্য কমতে থাকলেও তা আপনার চোখে লাগেনি। আপনি একদিনেই দেখেননি যে তাদের পোষাক কোমরের কাছে চলে এসেছে। প্রতি বছরেই হয়তো মাত্র চার আঙ্গুল পরিমান কমেছে। আপনি ভেবেছেন, এ আর এমন কি?
আপনার মনের মধ্যে ঘটে যাওয়া এমনই আরেকটি পরিবর্তনের কথা বলবো এবার। আপনার ছোট বেলাকার কথা আবার একটু ভাবুন। যখন আপনি ছোট ছিলেন আপনার পিতা-মাতা আপনাকে বড়দের সালাম দেওয়ার কথা শিখিয়েছিলো। খেলার মাঠে হোক আর স্কুলের ক্লাসেই হোক, আপনার থেকে বড় কাউকে দেখলেই আপনি সালাম দেওয়ার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছিলেন। কিন্তু আপনি বড় হতে থাকলেন আর আপনার সেই অভ্যাসটি আপনার থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। এরও কিন্তু কিছু কারণ রয়েছে। আপনার প্রতিবেশী দেশসহ বিদেশী সংস্কৃতি আপনাকে গ্রাস করে ফেলেছে। তবে, একদিনেই তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে এক একটা করে আপনার স্বভাবের পরিবর্তন করা হয়েছে। কোমল পানীয়’র নামে আপনার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এলকোহলের সামান্য ঝাঝ। আর বাকী পথটুকু হেটেছেন আপনি নিজেই। এটাকে মনের মধ্যের পরিবর্তন কেন বলছে তা জানেন? কারণ, আপনি এখন আর আপনার সন্তানকে সালাম দিতে শেখাননা। আপনি শেখান কি করে হ্যালো (Hello) বলতে হয় আর কি করে হ্যান্ড-শেক (Hand-shake) করতে হয়। আপনার মনের মধ্যে সালামের যে ভ্যালু ছিলো তা এখন আর একটুও অবশিষ্ট নেই।
নায়িকাদের পোষাকের কথা আগেই বলেছিলাম। তবে শুধু নায়িকাদের পোষাকই নয়, সংস্কৃতি জগতের প্রতিটা ক্ষেত্রই এভাবে বদলে গেছে। নাটকের গল্প, ভাষার ব্যাবহার, শালীনতার মাত্রা—সব জায়গাতেই বিদেশী সংস্কৃতির এমন অন্ধ অনুকরণ আর অনুসরণ যে আমরা আমাদের স্বকীয়তা ভুলতে বসেছি। আমাদের ঐতিহ্য এখন আর আমাদের টানেনা। আমাদের থ্রেশোল্ড-ভ্যালুকে এমনই এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে বিদেশী অশ্লীল আর নষ্ট সংস্কৃতির সাথে আমাদের কোন ডিশটিঙ্কশান আছে বলে প্রতীয়মান হয়না।
ঠিক এভাবেই, আমাদের সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি—সবকিছুকেই গ্রাস করে ফেলেছে বিদেশী অপনীতি। কংক্রিট বা এবস্ট্রাক্ট উভয় দিক থেকে আক্রমন করা হয়েছে আমাদের। সবকিছুই আমার আপনার গা-সওয়া বা চোখ-সওয়া হয়ে গেছে। নিজ ঘরেই প্রবাসী করে ফেলেছে আমাদের। হারিয়ে ফেলেছি আমরা আমাদের চিন্তার স্বার্বভৌমত্ব। ভৌগলিক স্বাধীনতা ছাড়া আর সকল ক্ষেত্রেই আমরা পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ। জাতি হিসেবে, এর থেকে লজ্জার আর অপমানের আর কি হতে পারে!!!