পরলোকবাসীদের আজ এক অতিশয় আনন্দের দিন। সকলেই অপেক্ষার প্রহর গুনিতেছে। পরলোকের নকীব আসিয়া ঘোষনা দিয়াছে, আজ ঈশ্বর তাহাদের দর্শন দেওয়ার ইচ্ছা পোষন করিয়াছেন। সেই সঙ্গে পরলোকবাসীদের একটা সুসংবাদও দেওয়া হইয়াছে। দর্শন দেওয়ার পাশাপাশি ঈশ্বর তাহাদেরকে চব্বিশ (২৪) ঘন্টাব্যাপী পৃথিবী ভ্রমনের সুযোগ দানের ঘোষনা প্রদান করিবেন। এই সংবাদে পরলোকবাসীদের মধ্যে আনন্দের ধুম পড়িয়া গিয়াছে। কে কাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে, কতজনের সহিত সাক্ষাৎ করা সম্ভব হইবে ইত্যাদি নানা চিন্তা লইয়া তাহারা ঈশ্বরের পানে পথ চাহিয়া রহিয়াছে।
পরলোকবাসীরা তাহাদের সকল কর্ম দ্রুত সম্পাদন করিয়া যেই ময়দানে ঈশ্বর দর্শন দেওয়ার ইচ্ছা পোষন করিয়াছেন সেই স্থানের দিকে হাটিতে লাগিল। পরলোকবাসীদের প্রায় প্রত্যেকেই ময়দানের দিকে আসিতেছে। জনে জনে জনারন্য হইয়া উঠিয়াছে ময়দান। হঠাৎ এক স্থানে কিছু লোকের কলহ দেখিয়া দুইজন ঈশ্বর-দূত সেইস্থানে দ্রুত ছুটিয়া আসিলেন। এবং ঘটনা যাহা ঘটিবে বলিয়া তাহারা ভাবিয়াছিলো তাহাই ঘটিতে দেখিয়া ঈশ্বর-দূতদ্বয় সামান্যমাত্রও বিস্মিত হইলেন না। একদল বাংলাদেশী পরলোকবাসী জায়গা দখলের জন্য একে অপরের সাথে কলহ বাঁধাইয়া দিয়াছে। কেহ একজন বলিয়া উঠিল, পৃথিবীতেও উহারা সরকারী জমি দখল করিয়া অপরের সহিত কলহ বাধাইয়াছিল। ঈশ্বর-দূতদ্বয় সকল শুনিয়া উহাদেরকে ঈশ্বর-সাক্ষাৎ পর্ব সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত পরলোকের কারাগারে আটক রাখিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঈশ্বরের দর্শন মিলিল। ঈশ্বর তাহাদের চব্বিশ ঘন্টা পৃথিবী ভ্রমনের সুযোগদানের পাশাপাশি মুহুর্তেই পৃথিবীর এপ্রান্ত হইতে ওপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটিয়া যাইবার ক্ষমতা প্রদান করিয়াছেন। তবে কাহারও সহিত সরাসরি সাক্ষাৎ করিবার ক্ষমতা প্রদান করেন নাই। অনেকেই ইহাতে সামান্য অসন্তুষ্ট হইলেও সকলকে যে স্ব-চক্ষে দেখিতে পারিবে তাহা ভাবিয়া যারপরনাই উৎফুল্ল হইয়াছে।
আর দশজন পরলোকবাসীর মত শেখ মুজিবুর রহমানও কোন্ কোন্ স্থান ভ্রমন করিবেন ইহা লইয়া বেশ চিন্তিত ছিলেন। অবশেষে, বঙ্গদেশের সকল স্থান ভ্রমন করতঃ তাহার স্বপ্ন কিরুপে বাস্তবায়িত হইতেছে তাহা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিবার ইচ্ছা লইয়া পরলোকে তাহার সার্বক্ষণিক সঙ্গী রাসুকে ডাকিলেন। রাসু হুজুরের ডাক শুনিয়া হন্তদন্ত হইয়া ছুটিয়া আসিলো। হুজুরের নির্দেশমত রাসু বঙ্গদেশে ভ্রমনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র সঙ্গে করিয়া হুজুরের নিকট উপস্থিত হইলো।
--সকল জিনিসপত্র ঠিকঠাক মত লইয়াছিস তো রাসু?
--জ্বী হুজুর। সবকিছুই লইয়াছি।
--আমার স্বপ্নের তালিকা খানি লইতে ভুলিস নাই তো?
--আজ্ঞে না হুজুর। উহাই তো সর্বপ্রথম লইয়াছি।
--আচ্ছা চল তাহলে, রওনা করি।
সর্বপ্রথম কোন স্থান হইতে ভ্রমন শুরু করিতে হইবে তাহা ভাবিয়া না পাইয়া রাসুর কাছে জিজ্ঞাসা করাটাই যুক্তিযুক্ত বিবেচ্য করিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, যদিও তাহার ঐকান্তিক ইচ্ছা হইতেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেতু ‘বন্ধবন্ধু যমুনা সেতু’ হইতেই ভ্রমন শুরু করিবার। সেতুর নিকটবর্তী হইতেই আনন্দের মন ভরিয়া উঠিল তাহার। ইহাই তো হওয়া উচিৎ। পাকিস্তানের জেলে বসিয়া যে স্বাধীন বঙ্গদেশের স্বপ্ন তিনি দেখিয়াছিলেন সেই বঙ্গদেশের সর্ববৃহৎ সেতুটি তাহার নামে হইবেক ইহাই তো স্বাভাবিক। রাসুর দিকে লক্ষ্য করিতেই রাসু বলিল, ‘আপনার প্রথম স্বপ্ন পুরণ হইয়াছে হুজুর’। অতঃপর তিনি সেতুর এপাশ হইতে ওপাশ পর্যন্ত দেখিয়া লইয়া সম্মুখভাগে অগ্রসর হইলেন।
--স্বপ্নের তালিকায় পরবর্তীতে কী নাম রহিয়াছে রে রাসু?
--আপনার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়।
--আমার সেই স্বপ্ন কি পুরণ হইয়াছে?
--জ্বী হুজুর। পূর্বাতন ‘পিজি হাসপাতাল’কে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে’ রুপান্তর করা হইয়াছে।
--কিন্তু আমি তো উহার নির্মানের সম্পর্কে কিছুই জানি না।
--উহা তো নতুন করিয়া নির্মান করা হইনাই হুজুর। শুধুমাত্র নামকরণ করা হইয়াছে নতুন করিয়া।
কথোপকথন করিতে করিতে শেখ মুজিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কোন স্থানে পাঠদান আবার কোন স্থানে রোগীদের চিৎকার শুনিয়া তিনি এই স্থান ত্যাগ করতঃ অপরাপর স্বপ্নের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন রাসুকে।
রাসু এইবার তাহাকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের দিকে লইয়া চলিল। হাজার হাজার দেশী বিদেশী মানুষ এই স্টেডিয়ামে আসিয়া খেলা উপভোগ করিবার পাশপাশি তাহার নাম জানিয়া যাইতেছে, উহা ভাবিয়া শেখ মুজিব বেশ পুলকিত অনুভব করিতে লাগিলেন। তাহার বেটি একেবারি উপযুক্ত কাজটাই করিয়াছে। জাতীয় স্টেডিয়ামটি তাহার একটা অন্যতম প্রধান স্বপ্ন ছিলো। দেশি-বিদেশী হাজার হাজার লোক তাহার গুনগান করিবে- এমনটাই তো তাহার স্বপ্ন। পরলোকে গমন করিয়াও কেমন বাঁচিয়া থাকা যায়!!!
এইমত বিভিন্ন স্থান ভ্রমন করতঃ ক্লান্ত হইয়া তিনি এইবার ফিরিয়া যাইবার ইচ্ছা ব্যাক্ত করিলেন। রাসুও দেখিল, তাহদের সময়ও শেষ হইয়া আসিতেছে। এদিকে সন্ধ্যা পার হইয়া রাত্র আসিয়া পড়িয়াছে। পরলোকের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করিবেন, এমন সময় নিয়ন আলোয় ‘Hazrat Shahjalal International Airport’ নাম দেখিয়া তিনি একটু থমকে দাঁড়াইলেন। রাসুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বিমানবন্দর কি আমার স্বপ্নের তালিকায় স্থান পায় নাই?’ রাসু জবাব দিলো,
--জ্বী হুজুর, উহা আপনার স্বপ্নের তালিকায় উপরের দিকটি দখল করিয়া লইয়াছিলো।
--তাহা হইলে আমার বিমানবন্দরের স্বপ্ন কি পূরণ হয় নাই?
--এই বিমানবন্দরটি পূর্বে সামরিক শাসক(!) জিয়ার নামে থাকায় উহাকে আর আপনার নামে নামকরণ করা সম্ভব হয় নাই। তবে আপনার উত্তরসূরীরা আপনার স্বপ্নের কথা একেবারেই ভুলিয়া যায় নাই। তাহারা আঁড়িয়াল বিলে আপনার নামে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মানের ইচ্ছা পোষন করিয়াছিলো।
--তাহা হইলে তুমি আমাকে সেখানে লইয়া চলিলে না কেন?
--কিন্ত অশিক্ষিত(!) জনগন তাহা বাস্তবায়ন করিতে বাধা প্রদান করিয়াছে।
--আমার সোনার ছেলেরা তাহলে কী করিয়াছে? তাহারা কি কম শক্তিশালী ছিলো?
-- (রাসু, একটু বিব্রত হইয়া) হুজুর, আপনি তো জানেন; জনগনই সকল ক্ষমতার উৎস।
কথোপকথন শেষ হইতে না হইতেই স্টেডিয়ামের ঐদিক হইতে প্রচন্ড শব্দ শুনিয়া ভড়কাইয়া গেলেন শেখ মুজিব। ‘এই চিৎকার চেচামেচিও কি আমার স্বপ্ন ছিলো?’ জিজ্ঞাসা করিলেন রাসুকে। ‘আজ্ঞে না হুজুর, উহারা তো বিশ্বকাপ উপলক্ষে উদ্ভোদনী অনুষ্ঠান করিতেছে। শুনিয়াছি, আপনাকেও উহারা স্মরণ করিতেছে।’ জবাব দিলো রাসু।
কিয়ৎক্ষণ কান পাতিয়া শুনিলেন শেখ মুজিব। সত্যি সত্যিই তাহার নাম লওয়া হইতেছে মাত্র কয়েক মিনিটের বিরতিতে। বিমানবন্দরের স্বপ্ন পূরণ না হইলেও তাহার নাম স্মরণ করতঃ এই অনুষ্ঠানের কথা জানিয়া প্রীত হইয়া বঙ্গদেশ ত্যাগ করিলেন পরলোকগত শেখ মুজিব।