প্রতিদিনের চেয়ে আজকের দিনটা একটু আলাদা হলো
নজিবের কাছে। হঠাৎ ধড়ফড় করেই ঘুমটা ভাংলো ওর। সাধারনত এরকম হয় না। আজ তবে কেন এমন
হলো? এলোমেলো কিছু ভাবনা ওর মনে আসলো। কিন্তু কোন কূল কিনারা করতে না পেরে বিছানা
ছেড়ে উঠে বসলো। উঠে বসতে বসতেই ওর মনে পড়লো আজ এশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচ। ভারত-বধ
আর লঙ্কা-জয়ের পর ফাইনালে খেলছে বাংলার দামাল ছেলেরা। অস্থির হয়ে উঠলো নজিব। মনটা
আনচান করতে লাগলো।
সকালের নাস্তা শেষ হতেই মানিব্যাগটা চেক করে
দেখলো টিকিটটা ঠিক জায়গায় আছে কিনা। মনে মনে শুধু আল্লাহ’র নাম জপছে আর বলছে, “হে
আল্লাহ! আজ যেন ম্যাশ একটু জ্বলে ওঠে। নাজমুল আর সাকিব একটু লাইন লেংথ ঠিক রেখে বল
করতে পারলেই হবে। তামিম যেন তার স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারে।”
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে দেয়ালের ঘড়িটার দিকে তাকালো
ও। প্রায় দশটা বাজে। একটু আগেই বের হতে হবে। শেরে বাংলার স্টেডিয়াম যে আজ লোকে
লোকারণ্য হয়ে যাবে। শেষে না আবার খেলা দেখাটাই মিস্ হয়ে যায়। ঘরের কোনে রাখা
প্লাকার্ডটা দেখে নেয় ও। লেখা রয়েছেঃ “আজ ষোল কোটি মানুষ তোমাদের সাথে রয়েছে।
এগিয়ে যাও বাংলার টাইগাররা।”
কলেজ স্টুডেন্ট নজিব অনেক বলে কয়ে বাবার কাছ
থেকে টিকিটের টাকা জোগাড় করেছিলো। যাতায়াত ভাড়ার জন্য এখন মাকে বলতে হবে।
প্রতিক্ষণেই তার চিন্তা বেড়ে চলেছে। আজ পারবে তো সাকিবরা? মুশফিক, তামিম নাজমুল,
নাসিররা আজ জ্বলে উঠবে তো? ওর মনে একটু আশার আলো দেখা দেয়। এখন তো আর আমাদের
শুধুমাত্র একজনের জ্বলের উঠার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়না। তামিম না দাড়ালে সাকিব,
সাকিব না পারলে নাসির। কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে যাবেই। মুশফিকটাও ঈদানিং কেমন
ম্যাচ-উয়ীনার হয়ে উঠেছে। তবু পাকিদের সুযোগ দিতে চায়না ও। আজ যেন সবাই দাঁড়িয়ে
যায়। “আল্লাহ, তুমি আমাদের সহায় হও”।
সেদিন বন্ধুদের সাথে আলাপের সময় ওর মনটাই খারাপ
হয়ে যায়। বন্ধুদের অনেকেই বলছে, “একাত্তরে একবার পাকিদের পরাজিত করেছি, আজ আবার করবো।”
মেনে নিতে পারে না নজিব। একাত্তর আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর
চেয়ে বড় অর্জন আর কিছু হতে পারে না। ক্রিকেটে বাংলাদেশ টেষ্ট স্টাটাস, ওয়ানডে
স্টাটাস পেয়েছে, শান্তিতে বাংলাদেশের ইউনুস পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নোবেল পুরস্কার
পেয়েছে। এগুলোর সবই আমাদের, আমাদের বাংলাদেশের অনেক বিরাট অর্জন। কিন্তু একাত্তর
না হলে যে এই বাংলাদেশটাই পেতাম না আমরা। আজ নজবের মনে শুধু বাংলাদেশের বিজয়ের
স্বপ্ন।
খেলা শুরু হতে আর মাত্র বিশ মিনিট বাকী। কিন্তু
স্টেডিয়ামের গেইট থেকে এখনো প্রায় আধা-কিলোমিটার দূরে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও।
দুশ্চিন্তায় ঘামতে শুরু করেছে। একটা বলো সে মিস করতে চায়না। আজ যে ইতিহাস তৈরি
করার দিন। ইতিহাস গড়ার প্রতিটা ক্ষণ সে উপভোগ করতে চায়। হঠাৎ গেটের কাছ থেকে কিছু
মানুষকে ছুটে আসতে দেখে নজিব। উৎকন্ঠায় আৎকে ওঠে সে। মাঠে ঢুকতে পারবে তো? ওর
সামনের মানুষগুলোও প্রাণভয়ে ছুটে পালাতে শুরু করে। ওদের দেখাদেখি নজিবও দৌড় শুরু
করে। ছুটতে ছুটতে শুনতে পেলোঃ গেটের কাছাকাছি কিছু লোক সবাইকে পাশ কাটিয়ে আগে মাঠে
ঢুকতে চাইলে অন্যরা বাধা দেয়। শুরু হয় উত্তেজনা আর মুহুর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে।
কিছু মানুষ কেন শুধু শুধু সুবিধা পেতে চায়?
সবাই তো খেলা দেখতে চায়। সবাই তো বাংলাদেশের জয় দেখতে চায়। এমন এলোমেলো ভাবতে
ভাবতে দৌড়াতে থাকে সে। কিন্তু তার ভাবনা বেশিদূর এগোয় না। হঠাৎ পেছন থেকে পুলিশের লাঠির
আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে, অজ্ঞান হয়ে যায়। ...