|| বাংলার নবাবের ওয়েবসাইটে স্বাগতম ||
আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া | ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া।

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৩

যেকারণে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ


সুন্দরবন যে কত সুন্দর তা গল্প বা ভ্রমন কাহিনী পড়ে আপনি কখনো বুঝতে পারবেননা।

 
আমার প্রথম সুন্দরবন ভ্রমন একটু ভিন্ন প্রকৃতির। চাকরির সুবাদের বড় ভাইয়ের পোষ্টিং তখন কয়রাতে। একদিন ফোন করে বললেন, “এখান থেকে একেবারেই কাছে সুন্দরবন। আয়, দেখে যেতে পারবি”। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। তিন চারদিন সময় হাতে নিয়ে চলে গেলাম কয়রা। বড় ভাইয়ের বাসা হতে মাত্র এক কিলো. দূরে সুন্দরবনএকটা বাই-সাইকেল নিয়ে আমি রওনা হলাম সুন্দরবন দেখতে। রাস্তাটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, একটা নদীর কিনারে। সাইকেলটা পাশে রেখে আমি কেবল মাথা উঁচু করে সামনের দিকে তাকিয়েছি। বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেলাম। সুন্দরবন এত্ত সুন্দর! আকাশে তখন ঝলমলে রোদ। সম্পূর্ণ পরিষ্কার নীলাকাশ। দিগন্ত রেখারের উপরে নীলের সাগর আর নীচে আলোয় ঝলমল সবুজের সমাহার। নদীর ওপার যে সুন্দরবন তা বোঝার জন্য কারো কাছ থেকে আপনার শুনে নিতে হবেনা। এপাশের গাছগুলো চিরচেনা, আমার প্রতিদিনের দেখা। কিন্তু ওপাশের গাছগুলো? এক্কেবারেই আলাদা। মনে হয় সেই বিশাল গাছগুলো সগৌরবে মাথা উঁচু করে জানান দিচ্ছে, “এইটা সুন্দরী সুন্দরবন। এইটা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সুন্দরবন, এখানটার সবকিছুই রয়্যাল”

আমি সত্যিই বলে বোঝাতে পারবোনা। মাঝখানে মাত্র একটা নদী। অথচ এপাশ আর ওপাশে কত ব্যাবধান! সেদিনই আমি প্রমত্ত সুন্দরী সুন্দরবনের প্রেমে পড়ে গেলাম। সাথে সাইকেলটা থাকায় প্লাস কিভাবে ভিতরে যেতে হবে না জানায় সেদিন অনেকক্ষণ ধরে এই সুন্দরীর সৌন্দর্য্য দেখেই ফিরে এসেছিলাম।
পরের দিন বড় ভাইয়ের বাড়িওয়ালার দুই ছেলে-মেয়ে আমাকে সুন্দরবন দেখাতে নিয়ে গেলো। ওদের ভাষ্যমতে, “এখান থেকে আপনি প্রকৃত সুন্দরবন দেখতে পারবেন। যারা ট্যুরে সুন্দরন যায়, তারা মুলত মেকাপ নেওয়া সুন্দরবন দেখে; প্রকৃত সুন্দরবন দেখার স্বাধ তারা পায়না”। যাইহোক, একটা নৌকা ভাড়া করে আমরা ভিতরের দিকে যেতে থাকলাম। যেতে যেতেই ওদের মুখে নানান গল্প শুনতে পেলাম। খুব বেশি ভিতরে গেলে যদি বাঘের সামনে পড়ে যাই সেকারণে ওরা দেখি বেশ সতর্ক। একটা গাছকে দেখলাম নদীর ওপরে এত বেশি নুইয়ে পড়েছে যে, নৌকা থেকে সহজেই গাছে চড়া যায়। আমি লাফ দিয়ে গাছে চড়ে বসতেই দেখি ওরা খুব উদ্বিগ্ন। “খুব শীঘ্রই নেমে আসেন ভাইয়া, হটাৎ যদি বাঘ চলে আসে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আপনার ঘাড় মটকে দেবে”। আসলে, কতটুকু ভিতরে গিয়েছি আর সেখানকার ভয়াবহতা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা না থাকায় আমার ভয়ও ছিলোনা। যাওয়ার আসার পথে বেশ কয়েকটা হরিণ আর বিভিন্ন রকমের পাখি দেখেছিলাম। শুধু বাঘ-মামার সাথে গল্প করার সুযোগটা পাইনি।

তারপর অনেকদিন কেটে যায়। প্রচন্ড একটা ঝড়ের খবর শুনছিলাম রেডিওতে। কিন্তু সেটা যে সিডরের মত এমন ভয়াবহ হবে তখনও বুঝতে পারিনি। বিকাল হতেই দমকা হাওয়া বইতে লাগলো। সন্ধ্যা যতই ঘনিয়ে আসলো, বাতাসও তত উম্মত্ত হতে থাকলো। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকলো বাতাসের বেগ। উদ্বেগ উৎকন্ঠায় সারারাপ প্রায় ঘুমই হলোনা। এক অজানায় আশংকায় পার করলাম সেই প্রলয়ংকরী সিডরের রাত। সকাল বেলা তখনো বুঝিনি কত ভয়াবহ ছিলো সিডরের তান্ডবতা; কারণ দুয়েকটা গাছ উপড়ে যাওয়া আর সাধারণ ঝড়ের লক্ষণ ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়েনি খুলনাতে। সময় পার হতে লাগলো আর সিডরের তান্ডবতায় ক্ষয়-ক্ষতি আর প্রানহানির খবর আসতে লাগলো। বাকীটুকু আপনারা জানেনে, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রলয়ংকরী সেই সিডর-ঝড় কিভাবে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছিলো পুরো দক্ষিনাঞ্চলকে।

পরের দিন পত্রিকায় সুন্দরবনের ছবি দেখে কান্না চেপে রাখতে পারিনি। নিজের জীবন দিয়ে আমাদেরকে রক্ষা করে গেলো সেই প্রমত্ত সুন্দরী সুন্দরবন। সেদিন ফুল-ফল লতা পাতায় শোভিত যে বাহারী সুন্দরবনকে দেখেছিলাম, আমার জীবন বাঁচাতে সে যে এইভাবে আত্মাহুতি দেবে, সিডর ঠেকাতে এমন কংকাল রুপ ধারণ করবে, তা স্বচক্ষে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না।

সেই সুন্দরবন, যে আমার জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বিলিয়ে দিলো; আজ তারই ধ্বংশের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। অথচ আমি কি নির্বিকার! আপনারা আমাকে মীরজাফর বলুন!