শিক্ষাদান একটা আর্ট বা শিল্প। এই শিল্পটাকে যত শৈল্পিক করা যায় ততই এর স্বার্থকতা। অন্য যেকোন কার্যক্রম থেকে এটা ভিন্ন এই অর্থে যে এখানে শিক্ষক প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের সাথে ভাব বিনিময়ের সুযোগ পান। খুব কম সংখ্যক প্রফেশানেই এই সুযোগটি রয়েছে। শিক্ষাদান তাই হওয়া চাই খুবই আদর্শিক আর উৎসাহব্যাঞ্জক। অন্যথায়, শিক্ষাদানের আসল উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হয়ে থাকে। শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর আগ্রহে দিন দিন ভাটা পড়লে শিক্ষাদানের প্রকৃত উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধুর হয়ে যেতে পারে।
প্রতিটা কার্য্যেরই একটা উদ্দেশ্য থাকে। প্রতিটা কাজের মধ্য দিয়ে এর অংশগ্রহণকারীরা একটা নির্দিষ্ট লক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। শিক্ষাদান বা গ্রহন কোনভাবেই এর ব্যাতিক্রম নয়। অন্তত এই ব্যাপারটার উপর গুরুত্ব দিয়ে হলেও শিক্ষাদানের স্বরুপ কেমন হওয়া উচিৎ তা নিরুপন করা জরুরী। প্রথমত বলে নেওয়া দরকার, আমাদের দেশে শিক্ষাদান আর দশটা প্রফেশানের মতই একটা প্রফেশান। পরীক্ষা দিয়ে ভালো নাম্বার তুলতে পারলেই এই প্রফেশানে আসা যায়। এই প্রফেশানে আসতে গেলে শিক্ষাদানের কোন যোগ্যতা থাকার প্রয়োজন হয়না। বরং এটা দেখা হয়, শিক্ষার্থী থাকাকালীন আপনি গলাধঃকরণের কাজটা কতটা সফলতার সাথে করতে পেরেছেন। খুব সহজ করে বলতে গেলে, আপনি যদি ক্লাসের ফার্স্টবয় হয়ে থাকেন, অর্থাৎ সর্বোচ্চ নম্বর তুলতে পারেন, শিক্ষক হওয়ার দৌড়ে আপনি কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। তাতে আপনার শিক্ষাদানের কোন যোগ্যতা থাকুক আর নাই থাকুক!
শিক্ষা একটা জাতির মেরুদন্ড। অথচ সেই শিক্ষারই মেরুদন্ড ভেঙে যেতে পারে যদি শিক্ষাদানের কারিগর শিক্ষকের যোগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। কিন্তু আশ্চর্য্যজনকভাবে সত্য হল যে আমাদের দেশে এটা খুবই কমন একটা ব্যাপার। কারণটা আগেই বলেছি, শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষাদানের চেয়ে শিক্ষা অর্জনের উপর অধিক গুরুত্বারোপ। আমি বলছি না যে শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীর শিক্ষাগ্রহনের উপর মোটেও গুরুত্বারোপ করা যাবে না। তবে যোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রার্থী শিক্ষাদানে কতটুকু দক্ষ সেটা দেখা জরুরী।
যে কথা বলছিলাম। শিক্ষাদান যেহেতু একটি আর্ট আর এখানে যেহেতু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমভাবে জড়িত, শিক্ষা কার্য্যক্রমে তাই উভয়ের সমান অংশগ্রহন অত্যাবশ্যক। অথচ অনেক ক্ষেত্রে ঘটে তার উলটো। আমি এমন একজন শিক্ষকের কথা জানি, যিনি ক্লাসে এসে শুধু নিজের মত করে বলেই চলেন। শিক্ষার্থী বুঝলো কি বুঝলো না সেদিকে তার কোন নজরই নেই, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করানোর ব্যাপার তো আরো দূরের কথা! শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পাঠ্য বিষয়টিকে উপস্থাপনের একটা বিষয় যে জড়িত এই শিক্ষকের সেই বিষয়টি জানা আছে কিনা আমার সন্দেহ। উনার ভয়েসের মডুলেশনও হয়না। তিনি শুধু ক্লাসে আসছেন, নিজের ভিতরে ধরে রাখা বিষয়টিকে উগরে দিচ্ছেন একটা নির্দিষ্ট মাত্রার ভলিউমে, আর চলে যাচ্ছেন। এইরকম একজন শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী কী আশা করতে পারে?
আমার জীবনে দেখা আরেকজন শিক্ষকের কথা আমি বলবো। উনার বিশেষত্ব এই যে উনি কখনো একটা বাক্য সম্পূর্ণ বলেননা। টেক্সটে থাকা কোন বাক্যকে তিন বা চার বার উল্লেখ করে তিনি মনে করেন ঐ বাক্যটিকে তিনি তিন বা চারটি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে বুঝিয়েছেন। নিজের থেকে কোন বাক্য বলতে গেলেই তিনি সেই বাক্যটিকে অসম্পূর্ন রাখেন। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে লাইন অব স্টেটমেন্ট (Line of Statement)। অর্থাৎ কোন বিষয় বলতে চাইলে সেই বিষয়টিকে প্রাধান্যে রেখে কথা এগিয়ে নেওয়া। আরও সহজ করে বলতে গেলে, আপনি যখন আপনার মুল কথা রেখে সাপোর্টিং কোন বিষয়ের কথা বলছেন, তখন ঐ সাপোর্টিং বিষয়টি শেষ করে আবারো মুল বিষয়ে ফিরে আসতে পারাটাই হল লাইন অব স্টেটমেন্ট। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলেও, আমার দেখা ঐ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকটি এই বিষয়ে এতই উদাসীন যে উনি মুলতঃ কোন বিষয়ের উপর আলোচনা করছেন তা বুঝতে পারা দুঃসাধ্য।
উপস্থাপনার কথা আগেই বলেছি। কোন একটি বিষয় কোন একজন বা কিছু সংখ্যক ব্যাক্তিকে বোঝাতে হলে, সেই বিষয়টির চমকৎকার উপস্থাপনা বিষয়টির অভ্যন্তরে শিক্ষার্থীর প্রবেশকে সহজ করে দেয়। প্রকৃতঅর্থে, শিক্ষাদান হচ্ছে এক বিশেষ ধরণের উপস্থাপনা। আলোচ্য বিষয়ের প্রাঞ্জল উপস্থাপনা তাই শিক্ষাদানের এক অনন্য উপাদান। অথচ একথা নিঃসন্দেহে সত্য যে, আমাদের দেশের প্রায় শতভাগ শিক্ষকের কাছেই উপস্থাপনার এই বিষয়টি উপেক্ষিত।
সর্বশেষ, একজন ভালো শিক্ষার্থীই যে একজন ভালো শিক্ষক এই ধারণাটি অনেকাংশেই ভুল। তুলনামুলক কম ভালো ছাত্রটিও অনেক ক্ষেত্রে একজন তুখোড় শিক্ষক হয়ে যেতে পারেন। আবার একজন ভালো শিক্ষার্থীও হতে পারেন একজন ভালো শিক্ষক। অতএব, শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে, যাকে নির্বাচন করা হচ্ছে তার শিক্ষার্জনের যোগ্যতার পাশাপাশি শিক্ষাদানের যোগ্যতা কতটুকু তা যাচাই করা অত্যাবশ্যক।